মোহাম্মদ সুমন◾
শাহ আব্দুল করিমকে আমরা 'বাউল সম্রাট', 'ভাটির পুরুষ' কত নামেই জানি। কিন্তু এর বাইরেও শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজ চিন্তক ও সমাজ সংস্কারক। অজপাড়াগাঁয়ের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তিনি অত্যন্ত সহজসরল ভাবে তার গানে তুলে ধরতেন অবলীলায়। আমৃত্যু অভাব-অনটনের সাথে যুদ্ধ করেছেন তবু অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি।
যৌতুকের বিরুদ্ধে শাহ আব্দুল করিম ছিলেন সোচ্চার। গাঁয়ের বিবাহযোগ্যা অষ্টাদশী তরুনীর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও তিনি গান লিখেছেন। যেখানে তরুণী তার ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বলছে-
একেতো অভাবের সংসার জামানা কঠিন,
খাইয়া বাঁইচ্চা চলা যায়না করিতে হয় ঋণ।
মা-বাপ যেমন পাগল রাইত দিন
চিন্তা করইন আমার দায়,
আমারে ঠেকাইছইন আল্লায়।
বড় ভাবিগো, আমারে ঠেকাইছইন আল্লায়।
শাহ আব্দুল করিম তার অনেক গানেই গরীবের প্রতি নিপীড়ন, শোষন-বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছেন।
এজন্য তাকে গণমানুষের কবিও বলা হয়। গরীবদেরকে নিয়ে এত গান কীভাবে লেখেন? এমন এক প্রশ্নের জবাবে করিম বলেছিলেন -'আমি নিজেও গরীব, তাই আমার গানে গরীবের কথা এসে যায়'। তিনি বলেন-
তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমি কবি
আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখদুর্দশার ছবি,
বিপন্ন মানুষের দাবী
করিম চায় শান্তি বিধান।
আবার স্রষ্টার প্রতি প্রেমময় অভিমান থেকেও করিম লিখেছেন-
গরীব থাকে ভাঙা ঘরে, কত কষ্ট করে
অনাহারে মরে, অন্ন জুটেনা
হলে দারুণ ব্যাধি, নাই তার ঔষধী
দারুন বিধি তোমার ভাব বুঝিনা
দয়াময় নামটি তোমার গিয়াছে জানা।
করিম নিপীড়িত হয়েছেন বার বার। শুধুমাত্র গান লিখার অপরাধে মসজিদে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। তার জানাজা না পড়ারও কথা উঠে! এ নিয়ে করিমের কোনো আক্ষেপ ছিলোনা। তিনি বলেছিলেন-'তারা আমার জানাজা পইড়াও আমারে আগাইয়া নিতে পারবে না, আবার না পইড়া পিছাইতেও পারবে না'।
করিমের মন ছিলো শিশুসুলভ। কিন্তু অভাবি করিম শূন্য পকেটে বাড়ির পাশের উজান ধলের মেলায় যেতে ভুলতেন না। স্ত্রী সরলা বেগমকে উদ্দেশ্য করে করিম লিখেন-
এই করিমের পয়সা নাই
রসগোল্লা খাই বা না খাই,
রস বিলাইতে আমি যাই
ওগো সরলা।
পহেলা ফাল্গুনে আইলো ধলেরই মেলা।
একই সাথে মেলায় খারাপ কাজ করতেও করিম মানা করেছেন। তিনি বলেছেন-
ঠিক রাখিও মনের গতি
জুয়া খেলায় দিওনা মতি,
ভাইরে ভাই কি যে ডাকাতি
তিন তাসের খেলা।
পহেলা ফাল্গুনে আইলো ধলেরই মেলা।
শাহ আব্দুল করিম কোনো স্কুলে লেখাপড়া করেননি, ছোটবেলায় মাঠে গরু চড়াতেন। নদীর ঢেউ করিমের মনকে প্রভাবিত করতো। নদী ও নৌকার সাথে মিশে থাকা মানুষের জীবন-জীবিকা, দুঃখ-কষ্ট শাহ আব্দুল করিমকে ভাবাতো। এসব চিন্তা ও উপলব্ধি থেকেই করিম লিখার অনুপ্রেরণা লাভ করেন।
২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার শাহ আব্দুল করিমকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন গণমানুষের এই কবি।
কেসিআর-২৪