কালনেত্র প্রতিবেদন◾
চা বাগানের অপরূপ দৃশ্য। চা গাছের ফাঁকে ফাঁকে পিঠে ঝুড়ি নিয়ে কাঁচা চা পাতা তোলা শ্রমিকদের সৌন্দর্য যে কাউকে আকর্ষণ করে। তাই তো দলে দলে লোকজন ছুটে যান চা বাগানে। কখনো পিকনিক করতে, কখনোবা পরিবার নিয়ে ঘুরতে। বাগানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেন। কখনো শ্রমিককে পাশে নিয়ে ছবি তুলেন। শ্রমিকের হাসিমাখা মুখের এ ছবি স্মৃতি হয়ে থেকে যায় আজীবন। কিন্তু শ্রমিকের এ হাসির আড়ালে যে রাজ্যের কষ্ট তা কি কেউ বুঝতে পারে?
এক সময় চা কী তা ভারতবর্ষের লোকজন জানতেনই না। ভারতবর্ষে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারণে এ উপমহাদেশ পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে প্রায় দুইশ’ বছর। চা-বীজ, চারা ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি চীন থেকে দক্ষ শ্রমিক আনে তারা। একসময় বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তারা চীন থেকে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দেয়। সেখানে দেশীয় শ্রমিক দিয়ে চা বাগানের কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। সুরমা ও বরাক উপত্যকা বর্তমান সিলেট ও আসাম অঞ্চল ছিল ভারতবর্ষের চা বাগানের একটা বড় অংশ। ড. সুকুমার বিশ্বাস রচিত ‘আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি প্রসঙ্গ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আসামে শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা যখন চা বাগান প্রতিষ্ঠা শুরু করেন, তখন স্থানীয়ভাবে চা শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল না। আসাম সরকারের সহায়তায় তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো চা শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করেন। বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশ থেকে এসব চা শ্রমিককে নিয়ে আসা হয়। এ জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগও চালু হয়। এ সময় আসাম সরকার ‘ইমিগ্রেশন অব লেবার অ্যাক্ট’ কার্যকর করে। চা বাগানের শ্রমিকদের তখন ডাকা হতো ‘কুলি’ নামে। চা শ্রমিকদের জন্য সরকারের কঠোর আইন, অপরদিকে চা মালিকদের প্রতি অপরিসীম ছাড় প্রদর্শনের এক অনন্য দলিল এই অ্যাক্ট।
যা চা শ্রমিকদের স্পর্শ করেছিল। ফলে ‘মুল্লুকে ফিরে চল’ স্লোগানে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু করেন। উদ্যোগ নেন নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু ফিরে যাওয়া অত সহজ ছিল না। চা শিল্পের মালিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রেল দপ্তর শ্রমিকদের টিকিট দেয়া বন্ধ করে দেয়। যাতে শ্রমিকরা ফিরে যেতে না পারেন। বাধ্য হয়ে তারা চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটমুখী হাঁটা শুরু করেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর চলে বৃটিশদের গুলিবর্ষণ। এতে মারা যান শত শত শ্রমিক। আর আহত হন হাজার হাজার। কিছু পালিয়ে যান। বাকিদের ধরে নিয়ে পুনরায় চা বাগানের কাজে বাধ্য করা হয়।
বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকরা দৈনিক ২৩২ রুপি পেয়েও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন। শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ শীর্ষ চা উৎপাদনকারী দেশ চীন ও কেনিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। প্রতি দুই বছর পর পর চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর চুক্তি হওয়ার কথা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আগের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ২০২০ সালের ১৫ই অক্টোবর শ্রীমঙ্গলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়। ওই চুক্তিতে চা শ্রমিকদের মজুরি ১০২ টাকা থেকে ১২০ টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কথা। মজুরি বাড়ানোর চুক্তি সই করতে চা শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হলেও মালিক পক্ষ আলোচনায় আসেনি। এ অবস্থায় চা শ্রমিক বাগানে বাগানে মিছিল, সমাবেশ, পথসভা ও সড়ক অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে ওরা এবং মজুরি বৃদ্ধির আলোচনাও অব্যাহত রয়েছে।
কিন্তু তাদের জীবনমানে কোনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৩৭ সালে চা শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা নিয়ে রচিত হয় সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘টু লিভস অ্যান্ড আ বাড’। ইংরেজ সাহেবদের অত্যাচারের পটভূমিকায় লেখা মুলকরাজ আনন্দের এই উপন্যাসে চা-কে অলঙ্কৃত করে বলা হয়েছে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’। এরপর দেশভাগ হয়। কিন্তু সেই একই চিত্র। চা শ্রমিকরা প্রকট মজুরি বৈষম্যের শিকার। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের চাকা ঘুরেনি। তাই এখনো ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয়। বর্তমানে ১২০ টাকা মজুরিতে তারা আর কাজ করতে পারছেন না। দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি দাবি তাদের। চা বাগান মালিকরা এ টাকা দিতে গড়িমসি করছেন। চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে দেশের ১৬৭টি চা বাগানে ৫ লাখের বেশি চা জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক প্রায় এক লাখ। একজন শ্রমিকের মজুরির ওপর কমপক্ষে ৫ জনের ভরণপোষণ নির্ভর করে।
আসাদ ঠাকুর
দ.ক.সিআর.২৪