আসাদ ঠাকুর◾
সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাচ্ছে কিনা এই প্রশ্নটি গত কয়েক বছর যাবৎ চোরাস্রোতের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সংবাদ, সাংবাদিকতা, সম্পাদকীয়— এই ধারণাগুলোরই গত তিন দশকে যথেষ্ট বিবর্তন হয়েছে।
যেমন ধরা যাক, অডিট ব্যুরো রিপোর্ট অনুসারে দেশে বর্তমানে দৈনিক সাপ্তাহিক মিলিয়ে হাজারের বেশি পত্রিকা রয়েছে। আর অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে যদি এই তালিকায় যোগ করি তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় পাঁচ হাজারের আশপাশে! অন্যদিকে পত্রিকার পাঠকের সংখ্যা হচ্ছে অনধিক পনের লক্ষ; আর ডিজিটাল পত্রিকার পাঠকদের বিবেচনায় নিলে এটা দাঁড়ায় সত্তর থেকে আশি লক্ষ। এই পাঠকদের একটা বিরাট অংশেরই প্রথাগত সংবাদে খুব একটা আস্থা নাই। তথাকথিত কোমল সংবাদ বা ঊনসংবাদে তাদের বিপুল আগ্রহ; আর বিনোদন পাতা হচ্ছে তাদের প্রিয় পাতা। মজার বিষয় হলো, বিনোদন পাতা আগেও ছিল। কিন্তু, ১৯৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত এই বিনোদন পাতা এবং এর কর্মীরা পত্রিকা অফিসে খুব একটা গুরুত্ব পেতেন না। বিনোদন পাতাটি থাকত ভিতরের অংশে; আর বিনোদন সাংবাদিকরাও প্রতিবেদক নন, বরং প্রদায়ক হিসেবেই বেশি বিবেচিত হতেন। দীর্ঘদিনের এই ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে এই শতকের গোড়া থেকে। শুরুটা হয়েছিল প্রধানত ক্রীড়া সাংবাদিকতার হাত ধরে, ক্রমে সিনে-সাংবাদিকতাও তার খুঁটি পোক্ত করে। ক্রমান্বয়ে সংবাদ এবং সাংবাদিকতা দুটোই নিজের বানানো ঊনসংবাদের আশ্রিত হয়ে উঠল।
উত্তর-নব্বই সময়ে বেশ কয়েকজন বাঘা বাঘা সম্পাদকের সচেতন প্রশ্রয়েই সংবাদের প্রচলিত সংজ্ঞাকে ভেঙ্গে দিয়ে বিনোদনকাহিনি সম্পূর্ণ নিজগুণে সংবাদের মর্যাদা অর্জন করেছিল! স্বল্পকালীন সাংবাদিক জীবনে শুনতে পেতাম এক বিখ্যাত সম্পাদক বিকেলে অফিসে এসেই কীর্তিমান নারীদের যুৎসই ছবি খুঁজতেন পরের দিনের পত্রিকায় ছাপানোর উদ্দেশ্যে; আর পাঠককে তা গেলানোর জন্য ঐ ছবির মিনিয়েচার ‘ইয়ার প্যানেলে’ (পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার সর্বোচ্চে দুই পাশে) বসিয়ে দিতেন। তো এ কাজটি করার জন্য কি সম্পাদক বা সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান খুব শক্তিশালী হওয়ার দরকার আছে?
এরপর তো এলো অনলাইন যুগ। এখানে সংবাদ আর ঊনসংবাদের ভেদ লুপ্ত হয়েছে; তাৎক্ষণিকতার আবরণে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন দুর্ঘটনায় বাইশ জন নিহত হওয়ার ছ’মিনিট পরই হয়ত নায়িকা শ্রাবন্তীর পঞ্চম বিয়ের আশু সম্ভাবনার সংবাদ ভেসে উঠছে। ফলে বিরাট সংখ্যক পাঠক শ্রেণি তাদের, আমাদের এবং সম্পাদককুলের অজান্তেই সংবাদের পাঠক হওয়ার পরিবর্তে ঊনসংবাদের গ্রাহক হয়ে উঠেছে। বিনোদনধর্মী এবং ফিচারাইজ্ড সংবাদের রমরমা অবস্থা সেই বাস্তবতারই ইঙ্গিত দেয়। ফলে শক্তিশালী সম্পাদকীয়েরও আর খুব একটা প্রয়োজন হচ্ছে না।
তাছাড়া সম্পাদকীয় তো শুধু সংবাদের ট্রিটমেন্ট নির্ধারণ নয়, এটা এক ধরনের রাজনীতিও বটে। এই রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা। আমাদের দেশের যেসব সম্পাদকের গুণে সম্পাদকীয় একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল তাদের সবাই-ই এই স্পর্ধার বিপুল সম্ভার। দুঃখজনকভাবে গত দুই দশকে এই রাজনীতি দারুণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। এখন সম্পাদকীয় রাজনীতি বলতে আর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা বোঝায় না, বরং ক্ষমতার মাঝে লীন হয়ে যাওয়ার মধ্যেই চরম স্বার্থকতা।
একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বেশ স্পষ্ট হয়ে যাবে। গত দুই দশক যাবতই দেশে নিয়মিত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালু আছে। প্রশ্ন হচ্ছে ক’জন সম্পাদক তাদের সম্পাদকীয়তে এটা তুলে ধরেছেন? কিংবা ক’জন সম্পাদক এই বিষয়ে তাদের পত্রিকায় দারুণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিয়েছেন? রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কথা বাদ দিলাম— এ সময়ে প্রায় তিরিশ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। একদিন কালো ব্যাজ পড়ে মানব বন্ধন করা ছাড়া ক’জন এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপানোর স্পর্ধা দেখিয়েছেন? শুধু সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা আর এক্ষেত্রে সম্পাদকদের ভূমিকা থেকেই বিষয়টি বেশ অনুমেয়। অনেকেই এক্ষেত্রে রাজনৈতিক অচলাবস্থার দোহাই দেন। কিন্তু এই অচল রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করাই সম্পাদকীয় রাজনীতি।
শুধু রাজনীতি নয়, গণমাধ্যমের অতি বাণিজ্যিকীকরণের কারণেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পাদকদের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব অনেকটুকুই সংকুচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে খুবই লক্ষ্যণীয় একটি প্রবণতা হচ্ছে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন ধরনের নির্বাহী বিশেষ করে প্রধান নির্বাহী পদটির গুরুত্বের অতি বৃদ্ধি। দুনিয়াজুড়ে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে গত শতকের সাতের দশক থেকেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা উৎকর্ষের নামে ব্যবসা প্রশাসন ডিগ্রিধারী লোকজনের গুরুত্ব বেড়েছে। পাশ্চাত্যের উদার গণতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থায় এই শ্রেণিটি বহু আগেই গণমাধ্যম দুনিয়ায় জায়গা করে নিলেও নব্য পুঁজিবাদী ও অবিকশিত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে এই প্রবণতা কিছুটা বিলম্বে শুরু হয়েছিল। তবে এই শতকের গোড়ার দিক থেকে শেষোক্ত দেশগুলোর গণমাধ্যম জগতেও এমবিএ ডিগ্রিধারীদের বিজয় কেতন উড়তে শুরু করেছে। গণমাধ্যমে কর্মরত এই শ্রেণিটি যতটা না সংবাদের প্রতি দায়বদ্ধ তার চেয়ে অনেক বেশি মালিক তথা প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য উৎসর্গীকৃত। এনারা গণমাধ্যমকে আর পাঁচটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে একই নিক্তিতে মূল্যায়ন করেন। ফলে সংবাদের সাথে বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে সেটা অনুধাবন করতে পারেন না। কিন্তু গণমাধ্যমের ব্যাপারটা হচ্ছে পাঠক অর্থের বিনিময়ে সংবাদ কিনলেও এটা ঠিক পণ্য নয়; এর বিনিময় মূল্যের পাশাপাশি আরেকটা মাত্রা রয়েছে— যেটাকে অর্থনীতির ভাষায় ইকোনমিক এক্সটার্নালিটি বলে। যেমন ধরা যাক, সুন্দর কোনও বাগান বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমাদের চমৎকার অনুভূতি হয়; একইভাবে ট্যনারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর কটু গন্ধে বিরক্ত হই। দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রত্যক্ষ আর্থিক সম্পর্ক না থাকার পরও একটি আমাদেরকে আনন্দ দিচ্ছে অন্যটি বিরক্ত করছে; এটাই হচ্ছে ইকোনমিক এক্সটার্নালিটি।
গণমাধ্যমগুরু রবার্ট ম্যাকচেজনির মতে, গণমাধ্যম এবং শিক্ষার মতো বিষয়গুলোকে বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের মতো শুধু অর্থের মানদণ্ডে বিচার না করে এর ইকোনমিক এক্সটার্নালিটির মাত্রাটিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ; এতে আখেরে রাষ্ট্র এবং সমাজ উপকৃত হয়। কিন্তু, আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম নির্বাহীদের নিকট ইকোনমিক এক্সটার্নালিটির প্রসঙ্গটি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। তাদের ব্যালান্স শিটসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কৌশলে শেষ কথা হলো মুনাফা। আর মালিক পক্ষও তাদের বিশাল লগ্নির কারণে একজন সংবেদনশীল সম্পাদকের পরিবর্তে এমবিএ ডিগ্রিধারী মুনাফাপ্রেমী নির্বাহীকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু, আমরা যদি গণমাধ্যমের ধ্রুপদী চার মাত্রা তথা অবহিতকরণ, শিক্ষিতকরণ, বিনোদিতকরণ ও প্রভাবিতকরণের ধারণাকে বিবেচনায় নিই তাহলে মুনাফার প্রসঙ্গটি এখানে অনেক দূরবর্তী বিষয়। অথচ, সর্বগ্রাসী মুনাফাচেতনার কারণেই সমকালীন গণমাধ্যম মালিকদের নিকট সম্পাদকের চেয়ে প্রিয় হচ্ছে প্রধান নির্বাহী। এর ধারাবাহিকতায় সংবাদ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেই ক্ষমতার দুটি বলয় গড়ে উঠছে। ফলে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্পাদকীয়ের দীর্ঘ দিনের কর্তৃত্ব আজ ক্রমক্ষয়িষ্ণু।
তাহলে কি ধরে নেব সংবাদ, সংবাদপত্র আর সম্পাদকীয়ের যেদিন গেছে একেবারেই গেছে? কিছুই কি নেই বাকি? এই প্রশ্নের উত্তরও এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সাদা চোখে সংবাদ এবং সম্পাদকীয় ক্রমক্ষয়িষ্ণু হলেও এর কোনও সম্ভাবনা নাই এমনটি ভাবা নেহায়েৎ অর্বাচীনের কাজ।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বার্থ, সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব প্রভৃতি বিষয়গুলোকে সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে না দেখে সততা ও আন্তরিকতার সাথে বিশ্লেষণ এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের অংশীজন বলতে শুধু সরকার, বিজ্ঞাপনদাতা, মালিক আর সাংবাদিক নেতাদের সমষ্টিকে নির্দেশ না করে দর্শক-পাঠককেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। এক কথায়, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ধারণাকে উল্লম্বভাবে না দেখে বরং আনুভূমিকভাবে দেখতে হবে। এতে করে গণমাধ্যম এবং এর ভোক্তাশ্রেণী—দুই পক্ষই উপকৃত হবে যা আখেরে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিকেই শক্তিশালী করবে।
সম্পাদক, দৈনিক কালনেত্র
দ.ক.সিআর-২৪