1. live@kaalnetro.com : Bertemu : কালনেত্র
  2. info@www.kaalnetro.com : দৈনিক কালনেত্র :
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন

তিপরা জাতি বৃহৎ বড়ো জাতির এক অন্যতম শাখা: অরুণ দেববর্মা

দৈনিক কালনেত্র
  • প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৪
  • ১৮০ বার পড়া হয়েছে

অরুন দেববর্মা◾

হিমালয়ের পাদদেশ হতে সমগ্র আসাম অধুনা বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব অঞ্চল, মেঘালয়, কাছাড়, ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে বঙ্গোপসাগর পাড় অব্দি এই জনগোষ্ঠী প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে বসবাস করে আসছে। তিব্বতী বার্মা ভাষাগোষ্ঠীর তিপরাদের সহোদর ও ঘনিষ্ঠ অংশগুলি হলো, মেচ, কোচ, বড়ো, গারো, সনোয়াল, তিয়া, কাছাড়ি তথা ডিমাসা চুটিয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতত্ত্ববিদদের মত অনুযায়ী বড়ো জাতি খৃষ্ট পূর্ব প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে তিব্বত ও পাটকই পাহাড় ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর ধরে একে একে সমগ্র আসাম ও তার নিম্নাঞ্চলে ছড়িয়ে বসবাস করতে শুরু করে। এই মতের সপক্ষে ভাষাতত্ত্ববিদ আব্রাহাম গিয়ারসন ও আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জোরালো মত পোষণ করেন। সমগ্র আসামে অহোম জাতির আগমনের পূর্বে বড়ো জাতির বিভিন্ন শাখার আধিপত্য প্রশ্নাতীত ছিল যার প্রমাণ কোচ, চুতিয়া, মান্ডি বা গারো, ডিমাসা, তিপরাদের রাজনৈতিক প্রভুত্বই সাক্ষ্য দেয়। গিয়ারসন সাহেবের ১৯০৩ সালে প্রকাশিত মানচিত্রে বৃহৎ বড়ো জাতির বিভিন্ন শাখার চিহ্নিত অঞ্চলগুলি স্পষ্টতই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। (ক্রমশ)

প্রাচীন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী কপিলীভ্যালীতে ছিল, এর সমর্থনে ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস শ্রীরাজরত্নাকরম ও শ্রীরাজমালায় উল্লেখ আছে। সেইসময় ত্রিপুরার রাজ্যের সীমা উত্তরে তৈউঙ্গ তথা ব্রহ্মপুত্র নদী দক্ষিণে আচরঙ্গ, পূর্বে মেখলি, পশ্চিমে কোচরঙ্গ।
“ত্রিবেগ স্থলেতে রাজা নগর করিল।
কপিল নদীর তীরে রাজ্যপাট কৈল।।
উত্তরে তৈউঙ্গ নদী দক্ষিণে আচরঙ্গ।
পূর্ব্বে মেখলি সীমা পশ্চিমে আচরঙ্গ।।
(প্রাচীন রাজমালা) ।।

 

ত্রিপুরার ইতিহাস বিষয়ক মূল আকর গ্রন্থ হচ্ছে শ্রীরাজরত্নাকরম। এখানে উল্লেখ আছে, চন্দ্রবংশীয় রাজা প্রতর্দ্দন এই অঞ্চল জয় করার আগেই লৌহিত্য নদীর তীরে ত্রিপুরা দেশের অস্তিত্ব ছিল, যার রাজ্যসীমা হিমালয়ের পাদদেশ হতে সাগরপাড় অব্দি বিস্তৃত ছিল এবং পশ্চিমদিকে ব্রহ্মপুত্র নদী। “যথা প্রতর্দ্দনঃ পূর্ব্বং ব্রহ্মপুত্রং সমাগত।
যোহসৌ ত্রিপুরারাজ্যস্য প্রান্তে বহতি পশ্চিমে।। ১।।”
“হিমবদ্ গিরিমাশ্লিষ্য সাগরান্তপ্রদেশগঃ। সুবর্ণরজতাদীনামাকরশ্চারুদর্শনঃ।। ৬।। রাজরত্নাকরম। দ্বাদশ সর্গঃ।।
এই প্রদেশের বর্ণনায় উল্লেখ আছে, এখানে নানা প্রকারের কিরাতজাতি, যারা আর্যদের আচারবলয়ের বহিঃস্থিত, যারা নীচশীল এবং স্বস্তিবচন (যা সামাজিককল্যাণসম্পর্কিত), স্বধাকার(যা শ্রাদ্ধাদিতে দ্রব্যদানসম্পর্কিত), ও স্বাহাকার (যা যঞ্জের আহুতিদানসম্পর্কিত) – এসব জানে না, এবম্বিধ মনুষ্যদের অধিকারে রয়েছে এই পর্বত। এখানে পর্বতের রমণীয় কন্দরগৃহের দ্বার মেঘে ঢাকা থাকে ও তার ভিতরে দিব্যাঙ্গনাগণ সর্বদা দেবতাদের সাথে বিহার করেন। ৬-১০।সেখানে দেবী মহাশক্তি ত্রিপুরা সুন্দরী ও ত্রিপুরেশ্বর তথা লিঙ্গরূপী মহাদেব ভৈরব বিরাজিত রয়েছেন।
“কিরাতভেদৈর্বহুভিরার্যাচারবহিষ্কৃতৈঃ।
নীচৈরধিকৃত স্বস্তি – স্বধা-স্বাহাদির্জ্জিতৈঃ।। ৯।।

যত্রাস্তে সা মহাশক্তির্দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী।ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ লিঙ্গরূপী সদাশিবঃ। ।১১।। রাজরত্নাকরম ।দ্বাদশ সর্গঃ।(ক্রমশ)।

(৫)

রাজরত্নাকরম ও শ্রীরাজমালার ভাষ্যমতে ত্রিপুর মহারাজা ও সুবরায় রাজার রাজত্বকাল দ্বাপরের শেষ পর্যায়ে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যদিও শ্রীরাজরত্নাকরম ও শ্রীরাজমালার রচনাকাল ধর্মমাণিক্যের আমলে (১৪৩১ – ১৪৬২খৃষ্টাব্দে)।আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উনার লিখিত বিখ্যাত “kirata – jana – krti” পুস্তকে বিবরণ দিয়েছেন, ” The first great king of the Tripura was Dharma – Manikya (c. 1431-1462).He was patron of learning, i.e,learning in Bangali and Sanskrit, although he himself was a Bodo speaker. He inaugurated, as we have just seen, the Raja – mala poetic chronicle of Tripura, in Bangali, and he settled Brahman in his realm and was himself a staunch Hindu. ” Kirata jana krti. Page 132.

এছাড়া ধর্মমাণিক্যের আমলেই সংস্কৃত ভাষায় ত্রিপুর রাজবংশের ইতিহাস শ্রীরাজরত্নাকরম রচিত হয় যা আমরা পূর্ব বিভাগ দ্বাদশ সর্গ অব্দি প্রতর্দ্দন কর্ত্তৃক ত্রিপুরা তথা কিরাতদেশ জয়ের কাহিনী বিধৃত আছে, তাতে পরিষ্কার দেখা গেছে, ত্রিপুরা তথা কিরাতধিপতি আর্য ধর্ম ও আচার অনুষ্ঠান বহির্ভূত অনার্য ছিলেন। কপিলী নদীর তীরে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী ও তার দক্ষিণ দিকে বর্তমান ত্রিপুরাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা ও সাগর পার অব্দি কিরাত জাতি তথা বৃহৎ বড়ো জাতির বিচরণ ক্ষেত্র বা আবাসভূমি ছিল ধরে নেওয়া যায়। সেইসময় দেবী মহাশক্তি ত্রিপুরা সুন্দরী চন্দ্রনাথ পাহাড়ে স্থিত ছিল যা পরবর্তীতে মহারাজ ধন্যমানিক্যের আমলে ১৫০৩ খৃষ্টাব্দে চন্দ্রনাথ পাহাড় হতে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে বর্তমান উদয়পুরে আনা হয় আর ত্রিপুরেশ্বর তথা মহাদেব ভৈরবরূপে বিরাজিত ছিলেন ছাম্বুল নগরে যা ঊনকোটির ভৈরব মূর্তিই সাক্ষ্য দেয়।

 

বৃহৎ বড়ো জাতির প্রধান আরাধ্য দেবতা হচ্ছে শিব্রাই বা বাথু আর অন্যদিকে শক্তিরূপী মাতা সাংগ্রংমা /হাচুক মা তথা যুদ্ধের দেবী রণচন্ডী। বাথু বুড়া বা শিব্রাইকে আপামর তিপরাসারা বুড়াসা দেবতা বলে মান্য করে এবং বুড়াসার সহধর্মিণীকে হাইচুকমা বা হাচুকমা বলে অভিহিত করে। এই শিব্রাই বা বাথু ধর্মকে পরবর্তীতে ব্রাহ্মণদের কূটকচালিতে শৈবধর্ম হয়ে যায় আর শক্তিদেবীর প্রতীক দেবী হাচুকমা বা সাংগ্রংমা রণচন্ডী হিসাবে শাক্তদেবীরূপে শাক্ত ধর্মের রূপ দেওয়া হয়। একথা ভূভারতে সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে শিব্রাই /শিব তথা মহাদেব অনার্য দেবতা আর উনার সহধর্মিণী হাচুকমা তথা পার্বতী অনার্য পাহাড়ী কন্যা বা দেবী। এখনও তিপরাসা ও ডিমাসাদের প্রধান শক্তিরূপী উপাস্য দেবী হাচুকমা তথা পার্বতী দেবীকে রণচন্ডী দেবী হিসাবে মান্যতা দিয়ে পরম ভক্তিভরে পূজা দেওয়া হচ্ছে। এখনও কাছাড়ে ডিমাসারা রনচন্ডীদেবীকে আর ত্রিপুরার তথাকথিত মাণিক্য রাজাদের রাজপ্রাসাদে রনচন্ডীদেবীকে পরম ভক্তিভরে নিত্য পূজা দিতে দেখা যায়।

 

বাথু বুড়া বা শিব্রাই শব্দটি বুৎপত্তিগত অর্থ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, বা হচ্ছে পাঁচ :থু মানে গভীর : বুড়া মানে জ্ঞানী :অন্যদিকে শিব্রাই শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, শি মানে জ্ঞানী :ব্রা বা বা মানে পাঁচ: রাই বা রায় হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বা রাজা :যারজন্য বড়োরা বাথুরাজা আর তিপরাসারা শিব্রাই রাজা বলে তাদের প্রধান উপাস্য দেবতাকে সম্বোধন করে। বা মানে পাঁচ তত্ত্বের জ্ঞানী দেবতা বা অধিশ্বর যিনি তুই, হর, নবার, হা তাই নখার নিয়ন্ত্রক যাকে বাংলায় জল, আগুন, বায়ু, মাটি বা ধরিত্রী আর আকাশ বলা যায়। আমার মনে হয় আর্য তথা ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অনার্য কিরাত তথা বড়ো জাতি হতেই পঞ্চ তত্ত্বের জ্ঞান আহরণ করে পরবর্তীতে সংস্কৃতে ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম এই তত্ত্বটি আপনিয়ে নিয়েছে। (ক্রমশ)।

(৬)

ত্রিপুরার রাজবংশকে যযাতি সম্ভূত চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় বলে ফলাওভাবে বলা হয়। ধরে নেওয়া যাক, প্রতর্দ্দন হতে অধ্বস্থন ৪৬ তম রাজা ত্রিপুর পর্যন্ত রাজাকে চন্দ্রবংশীয় বলে ধরে নিলাম, কিন্তু অত্যাচারী অপুত্রক রাজা ত্রিপুরকে দেব পশুপতি বধ করার পর এখানেই তো চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে, তাহলে পরবর্তী রাজাদের চন্দ্রবংশীয় রাজা নামে কিভাবে অভিহিত করা হয়েছে, অবাক করার বিষয়। রাজমালা চতুর্থ লহরের লেখক এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ লহরের রচয়িতা দূর্গামণি উজীর উনার প্রণীত শ্রেণীমালাতে এবিষয়ে স্পষ্টভাবে কি লিখে গেছেন, একবার দেখা যাক,

“চন্দ্রবংশের যযাতি ছিলেক নৃপতি।
তস্যপুত্র দ্রুহ্য হল কিরাতের পতি।।
তাহার বংশেতে দৈত্য(১)বলী রাজা ছিল। তস্য পুত্র ত্রিপুর(২)ত্রিপুরা রাজা হৈল।। তাকে বধিল যেন দেব পশুপতি।
তারপরে কহিতেছি হৈল যত ইতি।।
ত্রিপুরের পত্নী নাম্মী হীরাবতী ছিল।
শিব আরাধনে ত্রিলোচন (৩)পুত্র পাইল।। ত্রিলোচন নামে রাজা তিন চক্ষু ছিল। মহাদেব পুত্র হেন সকলে জানিল।। শ্রেণীমালা।। প্রথম পৃষ্ঠা।

 

ত্রিপুরার রাজবংশের তথা অন্যান্য ত্রিপুরা জাতির বংশের পরিচয় বা লতিকা তিনি এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন যা সত্যিই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তথ্যবহুল। তিনি বিশেষত কল্যাণমাণিক্যের আমল হতে উনার জীবৎ দশায় কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্যের (১৩৩ তম রাজা) আমল অব্দি রাজপরিবার তথা অন্যান্য ত্রিপুরাদের বিবাহাদি কারসাথে হয়েছে তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন যা সত্যিই অবিশ্বসনীয়। এখানে উল্লেখ্য, উনার বয়ানে কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্য যদি ১৩৩তম রাজা হন, ত্রিপুরার শেষ নরপতি বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য অব্দি ১৩৮ তম রাজা হওয়ার কথা, অথচ রাজমালার বয়ান অনুযায়ী ত্রিপুরায় ১৮৪ জন রাজা রাজত্ব করে গেছেন বলে উল্লেখ করা আছে।

 

ত্রিপুরার যে বৃহৎ বড়ো জাতির একটি শাখা একথা ভাষাতত্ত্ববিদ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উনার “কিরাত জন কৃতি” পুস্তকে পরিষ্কারভাবে লিখে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ এখানে ১৩০ পৃষ্ঠায় লিখিত বয়ান তুলে ধরা যাক, “Tripura state is now the only area where Bodo people still retain a good deal of their medieval political and cultural milieu, although Hinduisation has made rapid strides among them” এবিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনার “বাঙ্গালার ইতিহাস” বইতে চতুর্থ অধ্যায় আর্যীকরণ ১৪ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, “মোঙ্গলীয়েরা খর্বাকার, মস্তিষ্কের গঠন চতুষ্কোণ, হনুদ্বয় অত্যুন্নত। যদি কোন জাতিকে এমন পাওয়া যায় যে, তাহাদিগের শারীরিক গঠন মোঙ্গলীয়, তবে সে জাতিকে কখনও আর্য বলা যাইবে না। “তিনি হিন্দু হলেও চুটিয়া, কাছাড়ি, কোচ ও ত্রিপুরাদেরকে অনার্যজাতি বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তাহারাও হিন্দুধর্ম অবলম্বন করিয়াছে বলে উল্লেখ করেছেন। Rev. James long,” Analysis of Rajmala “প্রথমেই লিখেছেন,”It had been long the chosen abode of Sivism……. Siva destroying the Asura Tripura as being the favourite residence of Siva,…..” কৈলাসচন্দ্র সিংহ তিপ্রা জাতিকে শ্যানবংশীয় বিশালদ্রুমের একটি শাখা এবং তিপ্রা ও কাছাড়িগণ সেই শাখার দুটি অংশ, এই তিপ্রা শাখা হতেই বর্তমান রাজবংশের উদ্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। (ক্রমশ)।

দ.ক.সিআর.২৪

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
© 𝐰𝐰𝐰.𝐤𝐚𝐚𝐥𝐧𝐞𝐭𝐫𝐨.𝐜𝐨𝐦
ওয়েবসাইট ডিজাইন: ইয়োলো হোস্ট