➖
মীর ফয়সল আহমেদ ◾
হবিগঞ্জ বাংলাদেশর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা একটি জেলা। এ জেলার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আপনার মন প্রাণ জুড়াবে। হবি উল্লাহ নামে একজন ব্যাক্তি একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে হবিগঞ্জের নামকরণ। হবিগঞ্জ কে ১৮৭৮ সালে মহকুমা হিসেবে গঠন করা হয়, তারপর বৃহত্তর সিলেট জেলার অধিনে ছিলো। ১৯৮৪ সালে হবিগঞ্জ জেলা হিসেবে গঠন করা হয়। এই জেলার যেমন রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তেমনি রয়েছে নিজস্ব আচার, অনুষ্ঠান এবং সৌন্দর্যমন্ডিত দর্শনীয় স্থান।
সিলেট বিভাগে প্রবেশ করতে হলে হবিগঞ্জ কে স্পর্শ করে যেতে হয়। হবিগঞ্জ হলো সিলেট বিভাগের প্রবেশ পথ। এখান থেকেই সৌন্দর্যের লীলাভূমির শুরু। হবিগঞ্জ জেলা হাওর-বাওর ও সবুজে ঘেরা। এই জেলার রয়েছে উল্লখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। মাধবপুর উপজেলায় রয়েছে ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া। যেখানে মহান মুক্তিযু্দ্ধকে সহজ করতে রণাঙ্গন কে বিভিন্ন সেক্টর ভাগ করা হয়। এখানে চা বাগানের ডাক বাংলোতে বসে সারা বাংলাদেশ কে ১১টি সেক্টরে ও সাব সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অম্লান রাখতে এখানে বুলেট খচিত একটি স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে। এর পাশেই মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী শহিদের নামের তালিকা শ্বেতপাথরে লিখা রয়েছে।
চুনারুঘাট উপজেলায় রয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। সাত ছড়ি জাতীয় উদ্যানে দেখতে পাওয়া যায় মেছোবাঘ, বানর, উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর এবং নানান প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে প্রতি বছর সারা বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন। এখানে রয়েছে পিকনিক স্পট, কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আপনারা সেখানে ট্রেইলে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তাছাড়া এই জেলায় রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর অভয়ারণ্য রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। যেটা সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম বন। এখানে রয়েছে নানান প্রজাতির প্রাণী। বানিয়াচং নামক গ্রাম আছে যে গ্রাম হলো এশিয়ায় বৃহত্তম গ্রাম, এই গ্রামে রয়েছে বিথঙ্গল আখড়া, যা ষোড়শ শতকের দিকে তৈরি, এখানে বৈঞ্চব ধর্মাবলম্বী মানুষদের তীর্থস্থান রয়েছে। হবিগঞ্জের ভাটি অঞ্চল আজমিরীগঞ্জ, যেখানে সুরমা-কুশিয়ারা মিলিত হয়ে কালনী নদীর উৎপত্তি হয়েছে। দুমদুমিয়া বিল হলো আকর্ষণীয় একটা জায়গা, যা চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত, চা বাগানে ঘেরা উঁচ নিচু ঢিবি আছে। শীতকালে ফুটে লাল শাপলা।
বানিয়াচং উপজেলায় রয়েছে কমলাবতীর দিঘী, লোকমুখে শুনা যায় রাজা পদ্মানাভের স্ত্রী রানি কমলাবতী কে স্বপ্নে দেখায় যে, তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিলে এই দিঘীতে জলে পরিপূর্ণ হবে। প্রজাদের জলের দুঃখ-দুর্দশা দেখে, তিনি এই দিঘীতে নিজের জীবন বিসর্জন করেন। সিলেটে যেমন রয়েছে রাতারগুল জলাবন (সোয়াম্প ফরেস্ট) এখানেও রয়েছে লক্ষ্মীবাওর নামক সোয়াম্প ফরেস্ট। হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় রয়েছে ৪০০ বছর বয়সী একটি জামে মসজিদ। শংকরপাশা গ্রামে তা অবস্থিত। এই মসজিদ নিয়ে রয়েছে পৌরাণিক লোককথা।
হবিগঞ্জে রয়েছে ২৩ টি চা বাগান। ছোট ছোট পাহাড় রয়েছে যাকে টিলা বলা হয়। এই টিলা কে ঘিরে রয়েছে চা বাগান। লালচান্দ চা বাগান, দেউন্দি চা বাগান, চন্দিছড়ি চা বাগান, বৃন্দাবন চা বাগান এবং আরো একাধিক চা বাগান রয়েছে। টিপরা নামক উপজাতি রয়েছে সেখানের স্থানীয় বাসিন্দা। মাঝেমধ্যে হয়তো খাসিয়া বা মনিপুরীর দেখা পাবেন। যেখানে চা শ্রমিকরা পরম যত্নে চা পাতার কুঁড়ি তুলেন। তাদের মুখে কখনো ম্লান কখনো স্নিগ্ধ হাসি। যেন আপন মনে গেয়ে যাচ্ছে বাংলার গান৷ আপনার মনে তখন জীবনানন্দ দাশের ' বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতো বড় পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দয়েলপাখি– 'কবিতটির বাস্তব রুপ। কিংবা মনে হবে এ মনে হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বা এস এম সুলতানের রঙ তুলির আচঁড়ে ফুটে তোলা বাংলার মুখ।
তারপর রয়েছে বিশাল হাওর, যার স্থানীয় নাম ঘুইঙ্গাজুড়ি হাওর। যখন ধান ফলানো হয়, সবুজের সমারোহ হয়ে উঠে চারদিক। বর্ষায় পানিতে ঠাঁই পাওয়া যায় না, ভরা জলে যে নতুন যৌবন পায় হাওর। জেলেরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যায়। এ যেন সেই বাংলা যার রূপ রস আমরা গ্রহণ করতে চাই। বারবার ফিরে আসতে চাই 'শালিখের বেশে'। বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জে রয়েছে হাওর। হয়তো সুবীর নন্দীর ' ভুল করা কন্যার লাগি মন আনচান করে' সেভাবে আপনার মন চাইবে না এই অপরূপ সৌন্দর্য্য ফেলে আসতে। মীরপুর বাহুবল উপজেলা হয়ে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার পথে চা বাগানের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মৌলভীবাজার জেলায় প্রবেশ করবেন। রুপে ইতিহাসে এক সমৃদ্ধ হবিগঞ্জ জেলা ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে সমাদৃত।
মীর ফয়সল আহমেদ
কবি, শিক্ষাকর্মী ও কলামিস্ট
দ.ক.সিআর.২৪