আখতারুজ্জামান আজাদ◾
রাষ্ট্রের প্রায় সকল পর্যায়ে এখন ধর্মজীবিদের আবদার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। তারা বিরূপ হতে পারে, চটে যেতে পারে, ঘেঁটে যেতে পারে— রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গই এখন এমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বলা যায়— ধর্মজীবীদের ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা অনাপত্তিপত্র নিয়েই সরকার এখন দেশ চালাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্ধারণ থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি— সর্বক্ষেত্রই এখন ধর্মজীবীদের কবজায়। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা থাকলেও রাজনীতির জগতে বাংলাদেশের ধর্মজীবীদের দৌরাত্ম্য নেহায়েতই সীমিত। তাদের আহূত একেকটি সমাবেশে একেকবার লাখ-লাখ মানুষের সমাগম হলেও সমাবেশ-শেষেই তাদের অস্তিত্ব মিইয়ে যায়, রাজনৈতিক অঙ্গনে থাকে না তাদের ন্যূনতম প্রভাব, জাতীয় সংসদে প্রায়শই থাকে না তাদের একজনও প্রতিনিধি। আপাতচোখে বিশাল জনসমর্থন থাকার পরও, শীর্ষ ইসলামি নেতাদের রাজনৈতিক অভিলাষ থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মোড়কে সংসদে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেও ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে কখনোই হালে পানি পায়নি। কেন পায়নি?
সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামি পেয়েছিল আঠারোটি আসন, ইসলামি ঐক্যজোট একটি। ১৯৯৬ সালে জামায়াত তিনটে, ঐক্যজোট একটি। ২০০১ সালে জামায়াত ফের সতেরোটি আসন পেলেও তাদের প্রাপ্ত ভোটের একটা বড় অংশ ছিল বিএনপির, যেহেতু ঐ বছর থেকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছিল। এককভাবে নির্বাচন করলে জামায়াত ২০০১ সালেও ছিয়ানব্বইয়ের মতো তিন-চারটের বেশি আসন পেত না। এই বক্তব্যের প্রমাণ মেলে ঐ নির্বাচনে তাদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পরাজয়ের মাধ্যমে। মুজাহিদকে খালেদা জিয়া সেইবার মন্ত্রী বানিয়েছিলেন টেকনোক্র্যাট কোটায়। ২০০১-এ ইসলামি ঐক্যজোট আসন পেয়েছিল দুটো। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ থাকার পরও জামায়াত পেয়েছিল মাত্র দুটো আসন। আর কোনো ইসলামি দল একটি আসনও পায়নি। পরবর্তী নির্বাচন দুটো প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় সেই পরিসংখ্যান এই লেখায় উল্লেখ করা হলো না। বাংলাদেশে নিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দল আছে এক ডজনেরও অধিক, নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলিয়ে সত্তরটিরও বেশি। এই দলগুলো বিভিন্ন নির্বাচনের অব্যবহিত আগে নিজেদেরকে নিলামে তুলে বিভিন্ন জোটে অন্তর্ভুক্তও করে থাকে। তবুও ‘বিরানব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে’ সত্তরটি ইসলামি দল এগারোটি সংসদ নির্বাচন মিলিয়ে সাকুল্যে সত্তরটি আসনও পায়নি। জামায়াত বাদে একমাত্র ইসলামি ঐক্যজোটকেই দেখা গেছে কালেভদ্রে একটা-দুটো করে আসন পেতে, একানব্বই থেকে আট সাল অবধি তাদের প্রাপ্ত আসন সাকুল্যে চারটে। মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলাদেশে কেন ইসলামি রাজনীতির এই দৈন্যদশা?
অমুক মার্কায় ভোট দিলে দেশ থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, মসজিদে-মসজিদে উলুধ্বনি উচ্চারিত হবে, দেশ ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে; তমুক মার্কায় ভোট দিলে ইসলাম বেঁচে যাবে, বেহেশতের টিকেট পাওয়া যাবে, এসব প্রতীকে ভোট দেওয়া মানে খোদ আল্লাহ-রাসুলকে ভোট দেওয়া— ইত্যাকার বিচিত্র বর্ণাঢ্য ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা চালিয়েও বাংলাদেশের সত্তরটি ইসলামি দল এক নির্বাচনে সাকুল্যে পাঁচটি আসন পায় না। এসব দলের নারী কর্মীরা ভোট দেওয়ার জন্য গ্রামের সহজ-সরল কিষাণীদেরকে মাথা ছুঁইয়ে কসম কাটিয়ে পরে দেহের ভেতর থেকে পবিত্র কোরান শরিফের ছোট্ট কপি বের করে বলে ‘আপনি আমাকে ছুঁয়ে কসম কেটেছেন মানে কোরান মজিদ ছুঁয়ে কসম কেটেছেন, কারণ কসম কাটার সময়ে আমার শরীরে কোরান ছিল, অতএব আমাদের প্রার্থীকে ভোট না দিলে গজব নেমে আসবে’— বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়ায়ও কিছু ইসলামি দল বিভিন্ন সময়ে নিজেদের পক্ষে ভোট টানার অপচেষ্টা করেছে। কিন্তু বিধি বাম। তাদের এই নিঞ্জা প্রক্রিয়াও সফল হয়নি। প্রচণ্ড রকমের ধর্মভীরু হওয়া সত্ত্বেও এমনকি গ্রামীণ নারীরা পর্যন্ত ইসলামি দলগুলোকে ভোট দেন না। এক ওয়াজ মাহফিলে কয়েক লক্ষ লোকের সমাগম ঘটলেও সংসদ নির্বাচনে ঐ এলাকার ইসলামি প্রার্থী ভোট পান সাকুল্যে সাড়ে তিন হাজার। অন্তত ভোটদানকালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ভোটার চূড়ান্ত রকমের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। ধর্মীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক ধর্মকে, ধর্মের সাথে রাজনীতি ও রাজনীতির সাথে ধর্ম মেশানোকে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বাংলাদেশের অধিকাংশ সাধারণ মুসলমান কখনোই পছন্দ করেননি।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আকণ্ঠ ধর্মপ্রাণ হলেও, নিজের সুবিধাজনক মাত্রায় ধার্মিক হলেও, স্বার্থোদ্ধারের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মান্ধ হলেও দিনের শেষে তাদের সিংহভাগই ধর্মকে রাজনৈতিক রূপ দিতে অনিচ্ছুক। নিয়মিত ওয়াজ শুনলেও এ দেশের মুসলমানরা ওয়াজের বক্তব্য ব্যক্তিজীবনে খুব একটা বাস্তবায়ন করেন না। ইসলামজীবী সংগঠনগুলোর ডাকে সমাবেশে যোগ দিলেও বাড়ি ফেরার পর জেহাদি জজবা তারা বহাল রাখতে পারেন না। রাতের বেলা ফেসবুকে ‘বয়কট ফ্রান্স’ লিখে সকালে ফরাসি দোকান লা মেরিডিয়ানে লাইন ধরেন এক ডলারে পেট পুরে আইসক্রিম খাওয়ার জন্যে। মনে-মনে ইসলামি শাসনব্যবস্থা চাইলেও বাংলাদেশের মুসলমানদের ব্যক্তিজীবনে ইসলামি শাসন বা অনুশাসনের প্রতিফলন নেই বললেই চলে। তারাও জানেন— দেশে শতভাগ শরিয়া আইন কার্যকর হলে তাদের জন্য বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হবে। চুরির জন্য হাত কাটা পড়লে এ দেশের অধিকাংশ মানুষেরই হাত থাকবে না, জেনার জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা করা হলে এ দেশ শিগগিরই জনশূন্য হয়ে পড়বে। শরিয়া আইনের স্বপ্ন দেখা সহজ, এই আইনের দাবিতে ওয়াজ মাহফিলের মাঠে ভূমিকম্প ঘটানো সহজ, এই আইনের জন্য ‘বুকের শেষ রক্তবিন্দু’ বিলিয়ে দেওয়ার রোমান্টিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ; নিজের ওপর শরিয়া আইনের বাস্তবায়ন কঠিনের চাইতেও কঠিন। তাই, এ দেশের মুসলমানরা কখনোই মন থেকে শরিয়া আইন চাইবেন না। আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এই দেশ সাক্ষ্য দেয়— এ দেশের মুসলমানরা ইসলাম ততটুকুই পালন করেন, যতটুকু পালন করা নিজের জন্য সুবিধাজনক। ইসলামের যে অংশটুকু নিজের জন্য অসুবিধাজনক, সেটুকু পালনে এ দেশের মুসলমানদের আগ্রহের লেশমাত্র নেই।
রাষ্ট্রে ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের কথা মুখে বললেও বাংলাদেশের মুসলমানরা জাতীয় নির্বাচনের সময়ে ভোট দেয় ঠিকই ঐ আওয়ামি লিগের নৌকায় আর বিএনপির ধানের শিষে। পাশেই শূন্য পড়ে থাকে ইসলামি ঐক্যজোটের মিনার, জাকের পার্টির গোলাপ, খেলাফতে মজলিশের দেয়ালঘড়ি। ইসলামি শাসনের কথা ব্যালটে সিল মারার সময়ে বাংলাদেশী মুসলমানদের মনে থাকে না। ভোটের প্রশ্নে বাংলাদেশের মুসলমানসমাজ প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ। তারা ভালো করেই জানে— মোল্লার দৌড় সত্যিই মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা পর্যন্ত, এদেরকে দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা নেহায়েতই অসম্ভব। পাঁচ ঘণ্টার জন্য ওয়াজের মাঠ গরম করে রাখা আর পাঁচ বছরের জন্য দেশ চালানো এক কথা নয়। ওয়াজ মাহফিল আর ঢাকামুখী ইসলামি লংমার্চের পেছনেও যে প্রত্যক্ষ রাজনীতি ও মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন জড়িত, বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানরা সে ব্যাপারেও অবগত। তাই তারা বনভোজনের আমেজে ওয়াজে-লংমার্চে গেলেও নির্বাচনকালে তারা মিনারে ভোট না দিয়ে নৌকা আর ধানেই ভোট দেয়। বাংলাদেশের মুসলমানরা কোনো মওলানাকে বঙ্গভবনে-গণভবনে পাঠাতে ইচ্ছুক না, তাদের চাওয়া— রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীই বরং একটু ধর্মকর্ম করুক। মাথায় কালো পট্টি বেঁধে খালেদা জিয়া মাঝে-মধ্যে ওমরায় গেলেই বাংলার তৌহিদি জনতা খুশি, শেখ হাসিনা চোখ বুজে খানিকক্ষণ তসবি জপে ছবি তুলে বাজারজাত করলেই এ দেশের মুসলিম উম্মাহর আর কিছু দরকার পড়ে না, অতর্কিতভাবে রাষ্ট্রধর্ম চালু করায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাম্পট্যও এ দেশের ইসলামকামী মানুষেরা ভুলেই গেছেন। সুরা ফাতিহার শেষে ‘ওয়ালাদ দোয়াললিন’ হবে, নাকি ‘ওয়ালাজ জোয়াললিন’ হবে— এই নিয়ে সংঘটিত দ্বন্দ্বে যে দেশে দুজন মুসল্লি নিহত হতে পারে; সে দেশে কখনোই ইসলামি সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
বিগত অর্ধযুগে বাংলাদেশে অরাজনৈতিক মুখোশ পরা একটি ইসলামজীবী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। গোষ্ঠীটির ঊর্ধ্বতন নেতারা বিভিন্ন নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দলের শীর্ষসারির নেতা। রাজনৈতিক দল হিশেবে রাজনীতির মাঠে এদের আধপয়সার মূল্য না থাকলেও অরাজনৈতিকতার মুখোশ পরার পর এদের ধর্মবাণিজ্য নিষ্কণ্টক হয়েছে। রাজনৈতিক ইসলামকে এ দেশের সাধারণ মুসলমানরা কখনোই পাত্তা না দিলেও অরাজনৈতিক ইসলাম সবার কাছে বরাবরই নিরঙ্কুশ ও প্রশ্নাতীত আবেগ-অনুভূতির জায়গা। অরাজনৈতিক ইসলামের প্রতিপক্ষ হওয়ার সুযোগ কারোই নেই। রাজনৈতিক নিবন্ধন থাকা কোনো ইসলামজীবী গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইলে তাদেরকে মোকাবেলা করা মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু অরাজনৈতিক ব্যানারে ইসলাম নিয়ে প্রকাশ্যে বাণিজ্য করলে তাতে হাত দেওয়া ভীষণ রকমের বিপজ্জনক। হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটি সেই কৌশল অবলম্বন করে অর্ধযুগ যাবৎ অর্থনৈতিক আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। ওয়াজ মাহফিলগুলোর যে রমরমা অবস্থা, সেগুলোও টিকে আছে অরাজনৈতিক ইসলামের মোড়কে। ওয়াজ মাহফিলে রাজনৈতিক বক্তব্য উচ্চারিত হলে সেই ওয়াজের ওয়াজি ঘটনাস্থলেই শায়েস্তা হয়ে যাবেন, মুহূর্তমাত্র দেরি হবে না।
হেফাজতে ইসলাম পাদপ্রদীপের আলোয় প্রথম এসেছিল জামায়াতনেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে। এর আগে হেফাজতের পরিচিতি ছিল হাটহাজারির মধ্যেই সীমিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়াকে অরাজনৈতিক পরিচয়ে যতটুকু বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব, ২০১৩ সালে হেফাজত এর পুরোটুকুই করেছিল। বিচার বানচাল করার উদ্দেশ্যে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির যে এজেন্ডা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত হেফাজতকে হাটহাজারি থেকে মতিঝিলে পাঠিয়েছিল, হেফাজত তাতে শতভাগ সফল ছিল। অবিশ্বাস্য জেহাদি জোশ নিয়ে মতিঝিল দখল করলেও হেফাজত সেদিন ঢাকা ত্যাগ করেছিল কান ধরে। আড়াই হাজার লাশের মিথ্যাচার ছড়িয়েও হেফাজত-জামায়াত-বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্তব্ধ করতে পারেনি। পাঁচই মের পর গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজত-মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরি রিমান্ডে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন আর বলেছিলেন বিকেলের পর সেই সমাবেশের নিয়ন্ত্রণ আর তাদের হাতে ছিল না, ছিল জামায়াতের হাতে। অর্থাৎ হেফাজতে ইসলাম সেদিন ইসলাম হেফাজত করতে মতিঝিলে জড়ো হয়নি; জড়ো হয়েছিল জামায়াতে ইসলামিকে হেফাজত করতে, আল-বদরদেরকে হেফাজত করতে। প্রয়াত হেফাজত-আমির আহমদ শফি সমাবেশের প্রাক্কালে তুমুল ঔদ্ধত্যের সাথে বারবার বলেছিলেন— পাঁচই মের পর দেশ চালাবে হেফাজত। দেশ চালানো দূরে থাক, শফি শেষতক তার হাটহাজারি মাদ্রাসাটাও আমৃত্যু চালিয়ে যেতে পারেননি। কওমি-ছাত্রদের শফি-বিরোধী সহিংস আন্দোলনের মধ্যেই তাকে সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তার পুত্রকে প্রতিপক্ষ প্রহার করেছে পিতার মরদেহের সামনেই। ফের প্রমাণিত হয়েছে— ইসলামজীবী সংগঠনগুলোর শীর্ষনেতারা নির্বিঘ্নে একটি মাদ্রাসা শাসন করতেও সক্ষম নন, দেশ-শাসন তো দিল্লি দূর অস্ত।
যে আওয়ামি লিগ এখন হেফাজত-তোষণ করছে; সেই আওয়ামি লিগই ২০১৩ সালে দশ মিনিটের সামরিক অপারেশনে হেফাজতকে ঢাকাছাড়া করেছিল, পরদিন থেকে হেফাজতনেতাদেরকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরতে শুরু করেছিল, গগনবিদারী আওয়াজ নিয়ে ঢাকায় আসা হেফাজতকে বানিয়ে ছেড়েছিল কৌতুকচরিত্র। পাঁচই মে সাংবাদিকসম্মেলনে আওয়ামি লিগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন হেফাজত ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মা, আল-বদরদের উত্তরসূরি’। তিনি বলেছিলেন— ‘এবার তো হেফাজত ঢাকায় এসেছে, এর পরে ঢাকায় আসতে দেওয়া হবে না, প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরোতে দেওয়া হবে না। কেননা আপনাদের শক্তি আমরা ১৯৭১ সালে জেনেছি। আপনারা কাপুরুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আপনারা আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছেন, নিরীহ মানুষদেরকে হত্যা করেছেন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছেন। এই হলো হেফাজতে ইসলামের ইতিহাস। আপনাদের রক্তচক্ষুকে বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ ভয় পায় না। একাত্তরে আমরা আপনাদেরকে পরাজিত করেছি। আপনারা আবার সংঘাতের পথে এগোলে আপনাদেরকে শায়েস্তা করতে আওয়ামি লিগ একাই যথেষ্ট।’ এর পর দেশের পটপরিবর্তন ঘটেছে, আওয়ামি লিগের নির্বাহী নেতৃত্ব সৈয়দ আশরাফদের হাত থেকে ওবায়দুল কাদেরদের হাতে ন্যস্ত হয়েছে, কাদেরের আওয়ামি লিগ ক্রমশ নতজানু হয়েছে আশরাফের দাবড়ানি খেয়ে লেজ গুটিয়ে যাত্রাবাড়ির পথ ধরে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া হেফাজতের কাছে।
আওয়ামি লিগের এই হেফাজত-তোষণের কারণ একটিই— দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকা। ২০১৪ সাল থেকে দেশে কার্যত কোনো বিরোধীদল নেই, সরকারবিরোধী কার্যকর কোনো সভা-সমাবেশ নেই, সংসদে নেই সরকারিদল-বিরোধীদলের কোনো উত্তুঙ্গ উত্তপ্ত বিতর্ক। দেশে ছয় বছর ধরে আক্ষরিক অর্থেই বিরাজ করছে একদলীয় একচেটিয়া একপেশে রাজনীতি। একনায়িকাতান্ত্রিক ছয় বছরে দেশে কায়েম হয়েছে পরোক্ষ স্বৈরতন্ত্র। রাজনীতিশূন্যতার সুযোগে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও চলে গেছে বনবাসে। ভোটারবিহীন দু-দুটো নির্বাচনের পর দেশবাসী এখন জানেই না ফের কবে তারা উৎসবমুখর পরিবেশে ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারবে। বিএনপির অমেরুদণ্ডিতার সুযোগ নিয়ে আওয়ামি লিগ ভেঙে দিয়েছে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, সমূলে বিনাশ করেছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে আন্দামান-নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে। দেশে এই যে রাজনীতিশূন্যতা, সেটিরই সুযোগ নিয়েছে হেফাজত। দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে না, ভোটাধিকার থাকে না, রাজনীতি থাকে না; শাসকগোষ্ঠী তখন ভয়ে থাকে। ধর্মজীবী সংগঠনগুলোকে শাসকরা তখন যমের মতো ভয় পায়। ভাবে— এই বুঝি ধর্মের ধুয়া তুলে ধর্মজীবীরা সরকারপতন ঘটিয়ে ফেলল! অগণতান্ত্রিক শাসকরা রাজনৈতিক সংগঠনকে ভয় পায় না, ভয় পায় ধর্মীয় সংগঠনকে। বিএনপি-জামায়াত যখন মাঠেই নামতে পারছে না, তখন সেরেফ দেশকে অস্থিতিশীল করতে হেফাজতকে দিয়ে মাঝেমধ্যে তারা আওয়াজ ছাড়ে। হেফাজতের একাংশের সাথে আওয়ামি লিগেরও আঁতাত আছে। অর্থাৎ হেফাজত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে উভয় দিক থেকেই। রাজনীতিতে কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ পুঁজিপাট্টা ছাড়াই সাঁইসাঁই করে চলছে হেফাজতের ধর্মবাণিজ্য।
অনেকেরই ধারণা— আওয়ামি লিগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে ইসলামপন্থিরা দেশ দখল করে ফেলবে, শরিয়া আইন কায়েম করবে, দেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে। এই ধারণা খুব একটা সমূলক হবে আমার মনে হয় না। আমার ধারণা— বিএনপি ফের কখনও ক্ষমতায় এলে হেফাজতপর্যায়ের সংগঠনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। আওয়ামি লিগ ‘নাস্তিকবান্ধব’ দল বলে বাজারে তকমা প্রচলিত আছে। তাই ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামি লিগকে প্রতিদিন নিজেদেরকে ইসলামবান্ধব বলে প্রমাণ দিতে হয়, নিজেদেরকে পির-আউলিয়াদের চাইতেও বড় মুসলমান বলে জাহির করতে হয়, পাতলুন খুলে দৈনিক তিনবেলা দেখাতে হয়— আমাদের কিন্তু খতনা করানো আছে। বিএনপির গায়ে নাস্তিকবান্ধব সিল নেই, বরং আছে ‘ইসলামবান্ধব’ তকমা। বাংলাদেশের সত্তরটি ইসলামজীবী রাজনৈতিক দলের প্রায় প্রতিটিই কম-বেশি বিএনপি-নির্ভর। আওয়ামি লিগের চাইতে বিএনপিকেই তারা বেশি বন্ধু মনে করে। ক্ষমতায় গেলে হেফাজত মার্কা সংগঠনগুলোকে বিএনপি পাই-পয়সা দিয়েও গুনবে বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন হলে বন্ধুকে ভুলে গেলেও ক্ষতি নেই, শত্রুকে অবজ্ঞা করলে ঝুঁকি আছে। বিএনপির আমলে ধর্মব্যবসায়ীরা ঠিকমতো মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারে না, দাঁড়ানোর চেষ্টাও করে না। কেননা তারা জানে— ধর্মের প্রশ্নে আওয়ামি লিগ সুর নরম করতে বাধ্য, বিএনপির আমলে বেশি ধর্ম-ধর্ম করলে বিএনপি তাদেরকে উলটো গুঁড়িয়ে দেবে। ফলে দেখা যাচ্ছে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় থাকলেই ইসলামজীবীদের বেশি লাভ, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের ধর্মব্যবসার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।
২০১৩ সালে যে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় ছিল, তারা ক্ষমতায় এসেছিল দিনের নির্বাচনে; এখন যে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আছে, তারা ক্ষমতায় এসেছে রাতের নির্বাচনে। তৎকালীন আওয়ামি লিগ হেফাজত-দমন করেছিল, বর্তমান আওয়ামি লিগ হেফাজত-তোষণ করছে। এ কথা ইতিহাস-সিদ্ধ যে, দিনের বেলায় ক্ষমতায় এলে ধর্মীয় মৌলবাদীদেরকে তোয়াক্কা করতে হয় না; রাতের বেলায় ক্ষমতায় এলে ক্ষমতায় থাকা না-থাকা নির্ভর করে মৌলবাদীদের মর্জির ওপর। এ কথাও সত্য যে, হেফাজত বর্তমান আওয়ামি লিগের জন্য মোটেই হুমকি নয়। বরং হেফাজতকে সমাবেশ করতে দিয়ে আওয়ামি লিগ প্রমাণ করতে পারছে যে, দেশে গণতন্ত্র আছে, সভা-সমাবেশ করার অবাধ স্বাধীনতা আছে। ক্ষমতার প্রশ্নে এই হেফাজতই বিন্দুমাত্র গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে এই আওয়ামি লিগই টুঁটি চেপে ধরে হেফাজতকে ফের বোতলবন্দি করতে চব্বিশ ঘণ্টাও সময় নেবে না। হেফাজত ঠিক ততটুকুই বাড়তে পারছে, আওয়ামি লিগ যতটুকু বাড়তে দিচ্ছে। হেফাজতপ্রশ্নে আওয়ামি লিগ ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ নীতি অবলম্বন করে চলছে। হেফাজত যাতে বিগড়ে না যায়, যাতে জামায়াতে না ভেড়ে, যাতে অভিমান না করে— সে ব্যাপারে আওয়ামি লিগ নিজেদের কয়েকশো কর্মীকে কোরবানি করতেও প্রস্তুত; আবার বিগড়ে গেলে হেফাজতকে আশরাফ স্টাইলে শায়েস্তা করতেও প্রস্তুত। তবে, আওয়ামি লিগ যদি এই হেফাজত-হেফাজত খেলায় একবার পা হড়কায়, যদি আর একবার হেফাজত চলে যায় আওয়ামি লিগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আওয়ামি লিগ কোনোভাবে হেরে যায় এই হেফাজতক্রীড়ায়; শোচনীয়ভাবে হারতে হবে গোটা বাংলাদেশকে, গোটা দেশকে গুনতে হবে চড়া মাশুল।
দেশে বিদ্যমান ধর্মীয় পরিস্থিতি, ধর্ম অবমাননার গুজব তুলে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, অমুসলিম জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরে পরিকল্পিত হামলা— এসব দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে দেশে অচিরেই ‘ইসলামি বিপ্লব’ কিংবা ‘ইসলামি অভ্যুত্থান’ ঘটবে, জোব্বাধারী কোনো বড়হুজুর হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন এবং দেশে শরিয়া আইন কায়েম হবে। ইত্যাকার সব আশঙ্কাই অযৌক্তিক। সেরেফ ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার হলেই, নির্বাচন রাতে না হয়ে দিনে হলেই, রাজপথে রাজনীতি ফিরে এলেই দেশে বিরাজমান এই ধর্মীয় উন্মাদনা নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। অতীত সাক্ষ্য দেয়— ওয়াজকেন্দ্রিক ধর্মীয় নেতাদের আত্মবিশ্বাস নেহায়েতই কম, তাদের দৌরাত্ম্য লংমার্চেই সীমিত, পয়সাপাতির সম্মানজনক বিলিবণ্টন হলেই তারা বাড়ি ফিরতে আপত্তি করেন না। শক্ত প্রতিরোধের মুখে তাদের পলায়নের একাধিক ইতিহাস গত দেড় দশকেই রচিত হয়েছে। মোদ্দা কথা— একদলীয় রাজনীতি যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে, ভোটের অধিকার যতদিন পর্যন্ত নির্বাসিত থাকবে, খাইয়েদাইয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ঘাড়ে যতদিন অবধি চর্বি জমানো অব্যাহত থাকবে; দেশে ধর্মব্যবসায়ীদের আস্ফালন ততই বাড়তে থাকবে। ক্ষমতার রাস্তা নিষ্কণ্টক রাখার জন্য আওয়ামি লিগ ধর্মব্যবসায়ীদের পদতল যেভাবে চুম্বন করে চলছে, এর অবসান না ঘটলে লালমণিরহাটের আগুন ছড়িয়ে পড়বে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে। মুসলমান-অমুসলমান, নামাজি-বেনামাজি, মাজহাবি-লামাজহাবি নির্বিশেষে কেউই সেই আগুনের লকলকে শিখা থেকে নিস্তার পাবে না। মনে রাখতে হবে— লালমণিরহাটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পুড়ে মরা লোকটি মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও নামাজ পড়েছিলেন।
দ.ক.সিআর.২৪