➖
মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম◾
প্রত্যেক সমাজেই 'বিরলপ্রতিভা' জন্মগ্রহণ করে। সুন্দর সমাজ 'বিরল প্রতিভা' প্রতিপালন করে। পাঁচগাতিয়া গাঁয়ের নীলাকাশ, আকাশের বিজলী, সবুজ সোনালী ধানের অপরূপ ছন্দ আর দূর পাহাড়ের মেঘবিধুর ধূম্র মায়ার হতছানিতে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২০ শে জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার পাঁচগাতিয়া গ্রামে কৈলাস চন্দ্র নাথের ঔরসে ও তীর্থময়ী নাথের কোলজোড়ে এক দেবদূতের জন্ম হয়। পিতা মাতা নাম রাখেন পৃথিবীর অধিপতি। চমকে যাওয়ার মতো নাম! অকালে চলে না গেলে তিনি অন্তত জ্ঞান রাজ্যের অধিপতি হয়তো হতেন। তাঁর নাম ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথ।
তাঁর পিতা ছিলেন হোমিও চিকিৎসক ও গৃহস্থ। সামাজিক বিচার-আচারেও অংশ নিতেন। তিনি ছিলেন সৎ, বিনয়ী এবং নম্র স্বভাবের। মা ছিলেন আটপৌরে বাঙালি রমণী, বাঙালি মায়ের সমস্ত গুণাবলীর অধিকারিণী ছিলেন উনি। এ সমস্ত গুণাবলীর উত্তরাধিকারই ড. ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথ পেয়েছিলেন। আর নিজের মেধা ও পরিশ্রম তাঁকে সাধারণ অবস্থা থেকে সাফল্যের দরজায় এনে দিয়েছিল। শিশুকাল থেকেই ক্ষিতীশ অত্যন্ত সুদর্শন, নম্র-ভদ্র ও চৌকশ ছিলেন। তাই তো অল্প সময়েই সকলকে আকৃষ্ট করতেন। শিক্ষার প্রতিটি বাঁকে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীন দেশে এই বিরল প্রতিভার রহস্যজনক মৃত্যু মানুষের ইতিহাসে কলঙ্কের কালো ছায়া হয়ে থাকবে।
আমি যখন দক্ষিণাচরণ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন আমাদের সাথে ভর্তি হয় ডঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথের একমাত্র ভাতিজা কৌশিক নাথ। অত্যন্ত সাদামাটা সহজ-সরল কৌশিক যখন পরিচয় দিল তার কাকাও এ স্কুলের মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং তিনি ডক্টরেট ছিলেন। আর কাকীমা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তখন তাকে তো একটু সমীহ করতেই হয়।
বাল্লা রোড নিবাসী অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদের বাসায় আমাদের প্রায়ই যাওয়া হত, কারণ তাঁর ছোট পুত্র হুমায়ুন কবির মিলন আমাদের ক্লাসমেট ছিল। তাঁর কাছ থেকেও ডক্টর ক্ষিতীশ নাথের গল্প শুনেছি। তিনি বলতেন, ক্ষিতীশ এত মেধাবী ছিল যে, যেকোনো বই একবার পড়লে দ্বিতীয়বার পড়া লাগতো না। ও ক্লাসে প্রথম হতো আর আমি দ্বিতীয় হতাম, কিন্তু নম্বরের ব্যবধান থাকতো অনেক। অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ এক সময় বিমান বাহিনীর অফিসার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথের শিক্ষাজীবন ছিল খুবই বর্ণাঢ্য। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে মিরাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রধান শিক্ষক ছিলেন হরেন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর সাহচার্যে তৃতীয় শ্রেণীতে চুনারুঘাটের একমাত্র বৃত্তিধারী হয়ে চমকে দেন সবাইকে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মিরাশি জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কৃষ্ণধন ভট্টাচার্য, যিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন।
এই স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করলেও নানান অসুবিধার কারণে সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। এরপর শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু এখানেও থাকা-খাওয়ার অসুবিধার কারণে অবশেষে চুনারুঘাট দক্ষিণাচরণ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২৮ শে জুন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। খোয়াই নদীর কুল ঘেঁষে দক্ষিণাচরণ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। নদীর জলপ্রবাহের কলকল ধ্বনি ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথের কোষে ও হৃদয়ে অনুরণিত হতো।
তাঁর প্রতিভা এখানেও জ্বলজ্বল করেছে। এই স্কুল থেকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। প্রথম গ্রেডের বৃত্তি নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং বৃহত্তর সিলেটে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
এরপর অধিকতর শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডার যেখানে ছিল, সেই কুমিল্লায় যান। রামমালা ছাত্রাবাসে অবস্থান করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ হতে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
যার রক্তে খেলা করে অজানাকে জানার ছন্দ, কোষে অনুরণিত হয় জ্ঞান সমুদ্রে সন্তরণ—তাঁকে কে দমাতে পারে জ্ঞানের অভিযাত্রা থেকে? শৈশবের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রকৌশলী হবেন। তাই তিনি ছুটে যান চুনারুঘাটের আরেক বিরল প্রতিভা বুয়েটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর আব্দুর রশিদের কাছে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল দেখে ডক্টর রশিদ মুগ্ধ হন। তাঁর প্রেরণায় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বুয়েটে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হন।
মেধাবী শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকমণ্ডলীর সংস্পর্শে ক্ষিতীশ তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন।
যাঁর অফুরন্ত জ্ঞানতৃষ্ণা থাকে, তিনি তা বিতরণের জন্য শিক্ষকতাকেই বেছে নেন। কারণ, প্রতি মুহূর্তে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চার সুযোগ এ পেশায় পাওয়া যায়। শিক্ষকতা পেশা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ ব্রত। এই ব্রত নিয়ে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সারথী হিসেবে পেয়েছিলেন জ্ঞানতাপস ডক্টর আব্দুর রশিদকে, যিনি তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তাই ডক্টর ক্ষিতীশ সর্বদা ডক্টর আব্দুর রশিদকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করতেন।
যে শিক্ষার্থী শিক্ষক নামক বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নেয়, সে সবসময় সেই ছায়া অনুভব করে। ডক্টর ক্ষিতীশ সেই শান্ত ছায়া দানকারীদের কখনোই ভুলতেন না। তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল উপকারী বন্ধুদের প্রতিও। অন্যের একটুখানি উপকার করতে পারলে তাঁর হৃদয় তৃপ্তিতে ভরে উঠত।
জীবনের গতিপ্রকৃতি আরও সৃজনশীল ও গতিশীল হয় নর-নারীর বন্ধনে। তাই ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার পুড্ডা গ্রামের বিচার বিভাগের জজ দীনেশচন্দ্র দেবনাথের কন্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ঝরনা দেবনাথের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ভালোবাসার সরোবরে ভরে ওঠে।
এরই মধ্যে বিশ্বজ্ঞান ও বিশ্ববীক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে পৃথিবীর পথে পা বাড়াতে হয় তাঁকে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কলম্বো প্ল্যানের বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বস্ত্রীক ইংল্যান্ডে গমন করেন। সেখানে তিনি নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর মহীয়সী স্ত্রী সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
যাঁর চেতনায় দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মহান দায়িত্ববোধ ছিল, তাঁকে কোনো প্রকার পার্থিব সুযোগ বা মোহ আটকাতে পারেনি। পিএইচডি লাভের পর ইংল্যান্ডের অনেক নামিদামি ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে 'যত বেতন চান' তা দিয়ে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু দৃঢ়চেতা ক্ষিতীশ নাথ সকল মোহ ত্যাগ করে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে এসে ২৩ ডিসেম্বর তিনি পুনরায় শিক্ষকতায় যোগ দেন। ইতিমধ্যে তিনি দুই কন্যা সন্তানের পিতা হন। বড় মেয়ে কল্যাণী রমা নাথের জন্ম ঢাকায় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় মেয়ে সুলক্ষণা শ্যামা নাথের জন্ম ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে নিউক্যাসেলে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ—"সন্তান যেমন মায়ের কোলে ঘুমায়, ঠিক তেমনি বাংলা মায়ের কোলে শুয়ে ছিল বাংলার সন্তানেরা।" হঠাৎ কাল রাতের আঁধারে পাকিস্তানি মিলিটারির কালো থাবায় পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। ঐ রাতেই কয়েক লক্ষ মানুষ হত্যার পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা নিয়ে নামে ঘাতকরা।
সেই ভয়াল রাতে ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথ তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ ঢাকায় কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে নরসিংদী অঞ্চলের গ্রামেগঞ্জে পালিয়ে বেড়ান। গ্রাম থেকে গ্রামে শিশুদের নিয়ে নানা কষ্টের মধ্য দিয়ে দেশের আরও বহু অসহায় মানুষের সঙ্গে দিন কাটান। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় অগণিত শরণার্থীদের সঙ্গে বাসে-ট্রেনে চেপে দুই শিশু কন্যাসহ জলপাইগুড়িতে আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন।
কিছুদিন পর তিনি বোম্বে আইআইটিতে রিসার্চের কাজ পান। কাজ পেয়ে স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে বোম্বে আইআইটিতে অবস্থান করতে থাকেন। কিন্তু সারাক্ষণই তাঁর চিন্তায় ও হৃদয়ে থাকত মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলার মানুষ, মা, আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব। এসব ভাবতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত বিচলিত থাকতেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তাড়াহুড়া করে তিনি পরিবারকে রংপুরে শ্বশুরের কর্মস্থলে রেখে ঢাকায় তাঁর কর্মস্থলে যোগ দেন। উল্লেখ্য, বোম্বে আইআইটি এবং ভারতের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে কাজ করতে অনুরোধ করেছিল। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব সবাই তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন—"বিধ্বস্ত বাংলাদেশে এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই; ভারতই তোমার জন্য নিরাপদ।" কিন্তু তিনি সমস্ত কিছু ত্যাগ করে বাংলা মায়ের ডাক শুনে দেশে ফিরে আসেন।
ঢাকায় ফিরে এসে তিনি স্ত্রী ও কন্যাদের রংপুরে রেখে পিসিএসআইআর (বর্তমানে বিসিএসআইআর বা সাইন্স ল্যাব) এ যোগদান করেন। কিন্তু হায়, এই বুঝি ছিল তাঁর নিয়তি। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিজ্ঞান গবেষণার দীপ জ্বালাতে ফিরে আসা ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথকে ঘাতকের ষড়যন্ত্রে হারাতে হলো।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি পিসিএসআইআর-এর গেস্টহাউজে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
আমরা জানি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারি এ দেশের দোসরদের সহায়তায় ৩০ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এর মধ্যে দেখে দেখে প্রতিটি অঞ্চলে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবী নিধনের এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে, বিশেষত ১৪ ডিসেম্বর, বুদ্ধিজীবী হত্যার এই ধারাটি বেগবান হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধান বার্তা দিয়েছিল যে ঘাতকরা তখনও সক্রিয় ছিল।
সেই ঘাতকদের ষড়যন্ত্রে কি ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথও নিহত হয়েছিলেন? সদ্য স্বাধীন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। তাঁর মৃত্যুর খবর ঢাকা থেকে তাঁর স্ত্রীর ছোট ভাই, রংপুরের এডিসির টেলিফোনে জানান। পরদিন পত্রিকায়ও তাঁর মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়। ডক্টর ঝরণা নাথ ও তাঁর পরিবারের উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
মাও সেতুং বলেছিলেন, "কিছু কিছু মৃত্যু পাখির পালকের চেয়েও হালকা, আর কিছু মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী।" ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথের লাশ রংপুরে পাঠানো হলো। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, হঠাৎ স্বামীর মৃত্যু, দুটি শিশু কন্যা নিয়ে দূর রংপুরে থাকা—এ অবস্থায় ডক্টর ঝরণা নাথ এবং তাঁর পরিবার এই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে তৎপর হতে পারেননি।
নিজের কন্যাদের সুরক্ষা, শিক্ষা এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ডক্টর ঝরণা নাথ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। নিজেদের নতুনভাবে গোছানো শেষ করতে না করতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড ঘটে। এরপর সাধারণ মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিচারের দাবি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে।
এখনো আশা করা যায়, ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথের হত্যার রহস্য উদঘাটনের জন্য নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই গবেষণা করবে।
প্রতিভার প্রবাহ থেমে থাকে না। তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারী দুই কন্যা আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। এ দুজনেই তাঁদের পিতার পথ অনুসরণ করেছেন। কল্যাণী রমা নাথ এবং সুলক্ষণা শ্যামা নাথ দুজনেই ভারতীয় বৃত্তি পেয়ে খড়গপুর আইআইটি থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। বড় কন্যা রমা ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমিউনিকেশন বিষয়ে এবং ছোট কন্যা শ্যামা কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক হয়েছেন।
শ্যামা বর্তমানে আমেরিকার ইন্টেল-এ কাজ করেন এবং রমা একটি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত। ডক্টর ঝরণা নাথ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, "যে দীপ অকালে নিভে গেল, তা যদি তাঁর সন্তানেরা জ্বালিয়ে রাখতে পারে, তবেই অনেক শূন্যতার কিয়দংশ পূরণ হবে।"
ডক্টর ঝরণা নাথ ২০০০ খ্রিস্টাব্দে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর তিনি কখনো তাঁর কন্যাদের সাথে আমেরিকায় এবং কখনো বাংলাদেশে তাঁর বোন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সাথে থাকেন। এভাবেই তিনি আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে মিরাশি উচ্চ বিদ্যালয়ে ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথ বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিজ্ঞানাগারের দাতা ছিলেন ডক্টর ঝরণা নাথ এবং উদ্বোধন করেছিলেন আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মতিন। স্থানীয় ইতিহাস ও কৃতী ব্যক্তিদের পাঠ নিশ্চিত করা হলে শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক হতে পারত এবং শিক্ষা অর্জনে আরও অনুপ্রাণিত হতো।
ডক্টর ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথ যে আলোর আভা বিচ্ছুরিত করেছিলেন, সেই আলো মানুষের সভ্যতা ও প্রজ্ঞাকে আলোকিত করবে। চুনারুঘাটের মৃত্তিকা চিরে যে আলোক শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল, তা ঢাকার পিসিএসআইআর-এর গেস্টহাউজে ঘাতকের ষড়যন্ত্রে নিভে গেলেও জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে হয়—
**"ছাইয়ে যে আগুন ছিল, সেই সবও হয়ে যায় ছাই।
তবুও আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই।"**
তথ্যসূত্র:
অধ্যাপক ঝরণা দেবনাথ, স্মৃতি থেকে কিছু কথা; চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার এম. এ. মতিন, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি'৯০ এর পূর্ণমিলনীর স্মরণীকা।
লেখক পরিচিতি:
মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম,
সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস, লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজ, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার।
গ্রাম: চন্দনা, চুনারুঘাট পৌরসভা।
মোবাইল: ০১৭১১-০৬৪৬৬৫
ইমেইল: rubelmazharl@gmail.com
দ.ক.সিআর.২৪