➖
কালনেত্র প্রতিবেদন◾
দরিদ্র জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সহযোগিতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে এবং অর্থ ও সামাজিক উন্নয়নে সমাজের অবহেলিত ও হতদরিদ্রদের স্বাবলম্বী করার নিমিত্তে ক্ষুদ্রঝণ পরিচালনা করে আসছে নিশান সোসাইটি।
সংস্থাটি শুরু করেন ব্রাকের ক্ষুদ্রঋন প্রতিষ্ঠানের সাবেক অফিসার নিশান সোসাইটির বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মোঃ মইন উদ্দিন বেলাল। স্ত্রী আমেনা বেগমকে নিশানের ডেপুটি ডিরেক্টর, বড় ছেলে আঃ জলিল সায়েমকে এইচআর ডিভিশনে এবং ছোট ছেলে সালমানকে ডিপুটি ডিরেক্টর পদে বসিয়ে শুরু করে ছিলেন নিশান সমিতি। এবং সমিতির প্রারম্ভিক অর্থের জোগানদাতা হিসাবে কাছে টানেন শ্যালক সাবেক সেনা সদস্য জালাল উদ্দিন রুমিকে। বসান চেয়ারম্যানের পদে। শুরু হয় তেলিয়াপাড়া রেলক্রসিং এর অল্প আগে নিশান সমিতির কার্যক্রম।
কিছুদিন পর জনবলের প্রয়োজন দেখা দিলে নিয়োগ দেন পঞ্চম শ্রেনী পাস গোবিন্দ কৈরিকে, যিনি বর্তমানে তেলিয়াপাড়া হেড অফিসের এরিয়া ম্যানেজার। নিয়োগ দেন মনতলার জামাল উদ্দিনকে যিনি সময়ে সময়ে বড় বড় এফডিআর এনে দিতেন। আর মঈন উদ্দীন বেলালকে প্রলুব্ধ করে লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। তার দুর্নীতি বা অর্থ আত্মসাৎ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে যা-দিয়ে তিনি বাড়িতে বিশাল অট্টালিকা বানিয়েছেন। আরও নিয়োগ দেন মনিটরিং অফিসার গোলাপ খা কে, যার যোগ্যতা নবম শ্রেনী পর্যন্ত। এরিয়া ম্যানেজার শাহজাহান মিয়া দুলাল পঞ্চম শ্রেনী পাশ। এরিয়া ম্যানেজার মুজিবুর রহমান যার বিএ পাস সার্টফিকেটটি জাল। সহঃ শাখা ব্যবস্থাপক এমএ মান্নানের এইচএসসি পাশ সার্টিফিকেটটিও জাল। তারা প্রত্যেকেই এখনও নিশানে কর্মরত আছেন। এছাড়াও এরিয়া ম্যানেজার হারুনূর রশিদ ও মইনুল ইসলাম সহ জুয়েল গোয়ালা এদের প্রত্যেকেই নির্বাহী পরিচালক মঈন উদ্দিন বেলাল ও তার বড় ছেলে আব্দুল জলিল সায়েমের এফডিআর কর্মী ও পিতা পুত্রের সকল কাজে একত্বতা প্রকাশ করতেন। যেকারণে আজ মঈন উদ্দিন বেলাল এর একনিষ্ঠ এফডিআর কর্মী জুয়েল গোয়ালা গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে না পেরে প্যারালাইজড হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
এ ছাড়াও এরিয়া ম্যানেজার হারুনুর রশীদ আমুরোড অফিসের গ্রাহকদের প্রায় ১৫ কোটি টাকার আমানত মঈন উদ্দিন বেলাল ও তার স্ত্রী আমেনা বেগম, বড় ছেলে আব্দুল জলিল সায়েমকে এনে দেন বলে জানাযায়।
নিশানের বর্তমান পরিস্থিতির হুতা হিসাবে যাদের নাম আমাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তারমধ্যে অন্যতম নির্বাহী পরিচালক মঈন উদ্দীন বেলাল, তার বড়ছেলে আব্দুল জলিল সায়েম ও মাইক্রো ক্রেডিট ডিরেক্টর মাসুদ রানা। মাসুদ রানা ব্যাক্তিগত ভাবে প্রায় ১০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করে। বিগত ৩দিন থেকে এখন পর্যন্ত পলাতক আছে। পলাতক আছে মঈন উদ্দীন বেলালের ছোট ছেলে ডেপুটি ডিরেক্টর মোঃ সালমান। এদের প্রত্যেকেই সাধারণ মানুষকে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানতের টাকা গ্রহন করতেন। এবং সেই টাকা মঈন উদ্দিন বেলাল ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে জমা দিতেন।
আরও জানা যায়, নিশান সোসাইটির চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ভিন্ন স্বভাবের মার্জিত এক ব্যক্তিত্ব। যিনি আপাদমস্তক প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম নীতিতে অটল, বিনয়ী ও স্বল্পভাষী একজন স্ট্যান্ডার্ট মানুষ। তাছাড়া সমিতির সংবিধান বলে সভাপতি জালাল উদ্দিনকে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে খর্ব করে রাখা হয়। যেকারণে জালাল উদ্দিনের শ্রম ও মেধায় এগিয়ে চলা নিশানকে মঈন উদ্দিন গংরা দূর্নীতির আখড়া বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। তবে জালাল উদ্দিনের কর্য বাবদ আমানতের টাকায় গ্রাহকদের এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। প্রত্যেকেই তাদের শর্তমতে লভ্যাংশ পেয়ে আসছে। এবং তিনি তার আমানতের টাকার হিসাব প্রদানে সক্ষম বলে আমাদের জানান।
এক স্বাক্ষাতে জালাল উদ্দিন বলেন, গত ১৫ বছর নিশান সোসাইটি সমবায় সমিতির নিয়ম অনুযায়ী সদস্যদের মধ্যে ঋনদান পরিচালনা করে আসছে এবং মাইক্রোক্রেডিট অথরিটি (এমআর) থেকে নিবন্ধন নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মাধবপুর উপজেলা অফিসের ওয়েব সাইটেও নিশান তালিকাভুক্ত। অতীতে আমানত হিসাবে যা জমা হয়েছে তার মুনাফা প্রতি মাসে গ্রাহক ঠিক পেয়েছেন এবং পাবেন।ইনশাল্লাহ। আমার তরফ থেকে এখন পর্যন্ত নিশানে কোন অনিয়ম হয়নি। নির্বাহী পরিচালক ও তার পরিবার সহ কতেক কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পরিচালকদের রোষানলে আমি কোনটাসা হয়ে পড়ে ছিলাম। সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি কেবল। তবে প্রথম থেকে সংস্থাটি ঠিক নিয়মেই এগিয়েছে। এই ক’বছর আমানতের টাকা ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যবহার শুরু করায় গ্রাহক আমানতের সুদ ও আসল টাকা ফেরত পাচ্ছিল না। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছ থেকে শত কোটি টাকা সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নির্বাহী পরিচালক মঈনুদ্দিন বেলাল দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে গ্রাহকদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করতেন। আর এ কাজটি করেছেন মঈন উদ্দিন বেলাল, তার স্ত্রী আমেনা বেগম, বড়ছেলে আব্দুল জলিল সায়েম, ছোট ছেলে সালমান ও মাইক্রো ক্রেতিট ডিরেক্টর মাসুদ রানা। পঞ্চাশ টাকার ষ্টাম্প দিয়ে কর্জ হিসেবে ওরা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। ওই টাকা দিয়ে তারা জগদীশপুর তেমুনিয়ায় নিশান টাওয়ার, নিশান অটো ইট প্রস্তুতকরণ, মোটর সাইকেল শোরুম সহ বিভিন্ন ব্যবসা গড়ে তুলেন। বিলাসবহুল গাড়ি কিনে আয়েশি জীবন যাপন করছেন।
প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি পরিচালক আব্দুল জলিল সায়েম (নির্বাহী পরিচালকের বড় ছেলে) খালি স্ট্যাম্প ও ব্যাংক চেক দিয়ে করেছেন অর্থসংগ্রহের কাজ। আমেনা মটরস ও নিশান মটরস নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের খালি চেক প্রদান করতেন তারা। আমেনা মটরস চেকটি পূবালী ব্যাংকের নোয়াপাড়া শাখার। আর নিশান মটরস কৃষি ব্যাংকের তেলিয়াপাড়া শাখার। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ২টি ব্যাংকের একাউন্টে তাদের কোন ব্যালেন্সই জমা থাকে না। নেই তেমন কোন লেনদেনও। অন্যদিকে আমেনা মটরস ও নিশান মটরসের কোন কার্যক্রম লক্ষণীয় নয়। কতিপয় সমবায় সমিতির কর্মকর্তাদের ও প্রশাসনের কয়েক জনকে ম্যানেজ করে জনগণকে বোকা বানাতো তারা।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়, সংস্থাটি প্রায় ১৫০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন নামে। নিশানের অর্থ পরিচালক মাসুদ রানাও নিয়ম বহির্ভূত ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়েছেন। অন্যদিকে গ্রাহকদের সাথে করেছেন প্রতারণা।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে মাধবপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, নিশান সোসাইটি এমআরআই লাইসেন্স প্রাপ্ত হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে ছিল না।
এদিকে নিশানের কাছে টাকা জমা রেখে শত শত গ্রাহক হতাশায় দিন কাটাচ্ছিলেন। আমানতের সুদ ও আসল টাকা ফেরত চাইতে এসে প্রতিনিয়ত তাদের খালি হাতে ফিরতে হচ্ছিলো।
এ নিয়ে সম্প্রতি কয়েকজন প্রকাশ্যে কথা বলার পর গত সোমবার সারাদিন দেখা যায় নিশান অফিসের সামনে শত শত পাওনাদার টাকা ফেরত পেতে চিৎকার করছেন। এক পর্যায়ে গ্রাহকরা অফিসের ভেতর পরিচালক ও কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন।
পরিশেষে ইউপি চেয়ারম্যান পারভেজ চৌধুরী ও মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ বিন কাসিম নিশানের ৪ পরিচালকের সাথে রুদ্ধদ্ধার বৈঠক করেন। পরে ইউএনও উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, সবার টাকা ফিরিয়ে দিতে প্রশাসন চেষ্টা করছে। তারা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে (মঈন উদ্দীন, আমেনা বেগম ও জালাল উদ্দিন) তাদের পাসপোর্ট ও আব্দুল জলিল সায়েম এর এনআইডি কার্ড পুলিশের কাছে জমা রাখা হয়েছে। এবং আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে আঃ জলিল সায়েম, মোঃ সালমান, মাসুদ রানার পাসপোর্ট ও এনআইডি কার্ড জমা করার কথা রয়েছে। সেই সাথে সালমান ও মাসুদ রানাকে সশরীরে আলোচনায় উপস্থিত থেকে কে কার কাছ থেকে কি পরিমাণ টাকা নিয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের কোথায় কি পরিমাণ সম্পদ বা টাকা রয়েছে তার হিসেব করতে সময় চেয়েছেন। আশা করি নিশান আন্তরিক হলে মানুষের আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে।
তবে অবরোদ্ধ থাকার দিন ২৩ ডিসেম্বর নির্বাহী পরিচালক মঈনুদ্দিন সাহেব অসুস্থ্যতার ভান করে মুখের জবান বন্ধ হওয়ার নাটক করে ইউএনও এর অডিট মিটিংয়ে সাময়িক রেহাই পেলেও তার পরিবারের সকল সদস্যদের (আব্দুল জলিল সায়েম ও তার স্ত্রী, মোঃ সালমান ও তার স্ত্রী এবং মাসুদ রানা ও তার স্ত্রী) এর পাসপোর্ট, এনআইডি ও ব্যাংক একাউন্ট, স্বর্নালংকার সহ অর্জিত সকল সম্পত্তি জব্দ করা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি নিশানের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন রুমি গ্রাহকদের সাথে নিয়ম মাফিক লেনদেন অব্যাহত রাখতে পারেন এবং সংস্থার সংবিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে সক্ষম হন, তাহলে নিশান সোসাইটি আলোর মুখ দেখবে।
দ.ক.সিআর.২৪