➖
আসাদ ঠাকুর
সারা বিশ্বে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়ে থাকে। সেখানে লোকজনের ভিড়ও দেখার মতো। এরমধ্যে অন্যতম বইমেলাগুলো হলো- লন্ডন বইমেলা, আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ), আবুধাবি বইমেলা ইত্যাদি। আর আমাদের বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে বইমেলা। কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না এই বইমেলার ইতিহাস। কীভাবে শুরু বইমেলা, কে বাঙালির এই প্রাণের মেলা সূচনা করেন?
বাংলাদেশে বইমেলার উদ্ভবের ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। বইমেলার চিন্তাটি এ দেশে প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েন উদ্দীনের। তিনি বাংলা একাডেমিতেও একসময় চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। এরমধ্যে একটি বই ছিল Wonderful World of Books. এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো : ‘Book’ এবং ‘Fair’. কত কিছুর মেলা হয়। কিন্তু বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে এই বইমেলা কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি তিনি এই বই পড়েই বুঝতে পারেন। বইটি পড়ার কিছু পরই তিনি ইউনেসকোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবছিলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তখন তার মাথায় আসে, আরে প্রদর্শনী কেন? এগুলো নিয়ে তো একটি শিশু গ্রন্থমেলাই করা যায়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাই করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচ তলায়। যত দূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। শিশু গ্রন্থমেলা করে সরদার জয়েনউদদীন পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি। আরও বড় আয়োজনে গ্রন্থমেলা করার তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সুযোগটি পেয়েও যান। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সেসব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম।
মেলায় সরদার জয়েনউদ্দীন একটি মজার কান্ড করেছিলেন। মেলায় যে রকম বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন, উৎসুক দর্শকরাও এসেছিলেন প্রচুর, বইয়ের বেচাকেনাও মন্দ ছিল না। কিন্তু তাদের জন্য ছিল একটি রঙ্গ-তামাশাময় ইঙ্গিতধর্মী বিষয়ও। মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল ‘আমি বই পড়ি না’। সরদার জয়েনউদ্দীন সাহেবের এই উদ্ভাবনা দর্শকদের ভালোভাবেই গ্রন্থমনস্ক করে তুলেছিল বলে অনুমেয়। এখানেই সরদার জয়েনউদদীন থেমে থাকেননি। ১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেসকো ওই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সরদার সাহেব এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।
সব ধরনের মেলা থেকে ব্যতিক্রমধর্মী মেলা হলো বইমেলা বা গ্রন্থমেলা। এ মেলায় থাকে শুধু বই আর বই। এ মেলার বিশেষত্ব হলো, এখানে সংস্কৃতিমান শিক্ষিতজনদের সমাবেশ ঘটে। জ্ঞানপিপাসু ও বইপ্রেমী হাজারো মানুষের মিলনমেলায় রূপ নেয়। বইমেলায় ক্রেতারা লেখক, প্রকাশক ও অন্যদের সঙ্গে পরস্পর ভাব বিনিময়ের সুযোগ পায়।
তাছাড়া বইমেলা পাঠকদের বইয়ের প্রতি আরো আগ্রহ বাড়ায়। মেলার প্রতিটি স্টলে যেভাবে বিভিন্ন বই সাজানো থাকে, তাতে ক্রেতারা অতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।
একুশে বইমেলা আমাদের বাঙালি জাতীয় চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ মেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের মাতৃভাষার প্রীতি ও স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে একুশে বইমেলার অনন্য অবদান অনস্বীকার্য।
লেখক: আসাদ ঠাকুর, কবি ও সাংবাদিক
দ.ক.সিআর.২৫