➖
রাজেকুজ্জামান রতন◾
জীবনের চাইতে বড় কিছু নাই এটা সবাই জানে। কিন্তু মানুষ কখন জীবনকে তুচ্ছ করতে পারে? কখন একটা আদর্শ তাকে কর্তব্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় ? কখন নিজের চাওয়া পাওয়ার হিসেব না করে জনগনের চাওয়া পাওয়ার বিষয়টিকে প্রধান করে দেখতে পারে? যখন পারে তখন তা অসংখ্য মানুষকে শুধু সাহসী করে তাই নয়, মানুষের মনে স্বপ্নের বীজ বপন করে দেয়। এমনি অনেক সাহস আর স্বপ্নের দিন আছে আমাদের দেশে। মৃত্যু আর নির্যাতনে অশ্রু আর বেদনায় ভরা সেসব দিন নয়, স্বপ্ন আর সাহসের বারুদে ঠাসা সেইসব দিন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঁক ফেরানোর মত এমন অনেক ঘটনার ভিড়ে জ্বল জ্বল করছে একটি দিন, ১৪ ফেব্রুয়ারি, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। রক্ত ঘাম আর অশ্রুতে মাখামাখি করে যে স্বাধীনতা আমরা পেলাম, রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই আমরা দেখলাম আমাদের স্বপ্নের মৃত্যু। শিক্ষার অধিকার, গণতন্ত্র আর শোষনমুক্তির আকাংখা কি অধরাই থেকে যাবে? এই প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আর তাতিয়ে তুলেছে ছাত্রদেরকে প্রতিনিয়ত। এরকম সময়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্ররা ।
অতীতের সমস্ত স্বৈরশাসকের মত স্বৈরাচারী এরশাদ তার দমন নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়ে দেয় ছাত্রদের উপরে। একদিকে দমন অন্যদিকে শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেয়া, শিক্ষার বিষয়বস্তু পাল্টে দেয়ার কাজ শুরু করে প্রণয়ন করে মজিদ খানের শিক্ষা নীতি। যার মর্মবস্তু ছিল - শিক্ষার অধিকার সবাই পাবে না, উচ্চ শিক্ষা হবে সীমিত এবং ৫০ শতাংশ আসন থাকবে তাদের জন্য যাদের টাকা দেয়ার সামর্থ্য আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসন খর্ব করা হবে, সাম্প্রদায়িক সিলেবাস প্রণীত হবে, শিক্ষাকে শিল্পে বিনিয়োগের মত করে দেখতে হবে ইত্যাদি।
ছাত্ররা মানে নি, ফুসে উঠেছিল,রুখে দাড়িয়েছিল ছাত্র সমাজ। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসুচীতে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং জাফর, কাঞ্চন,জয়নাল, দীপালি সাহা সহ নাম না জানা অসংখ্য সাথীর মৃত্যুতে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে দাবী উঠে- সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক, একই পদ্ধতির শিক্ষা চাই। পরবর্তীতে প্রণীত হয় ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক ১০ দফা।
১৪ ফেব্রুয়ারির চেতনার আলোয় যদি বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান শিক্ষা কমিশনগুলো যাচাই করা যায় তাহলে একদিকে যেমন প্রত্যাশার ব্যর্থতায় দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়ে উঠে তেমনি প্রতীজ্ঞাও কি দৃঢ় হয় না? যেমন ১. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭২) ২. জাতীয় কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন কমিটি (১৯৭৬) ৩. জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি (১৯৭৮) ৪. মজিদ খান শিক্ষা কমিশন (১৯৮৩) ৫. মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন (১৯৮৭) ৬. শামসুল হক শিক্ষা কমিশন (১৯৯৭) ৭. এম.এ বারী শিক্ষা কমিশন (২০০১) ৮. মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন (২০০৩)৯. কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন (২০০৯) কোনটিতেই কি ছাত্র সমাজের আকাংখার প্রতিফলন ঘটেছে? ঘটেনি, তাই আন্দোলনও থামতে পারে না।
শাসকেরা ভুলিয়ে দিতে চায় সংগ্রামের ইতিহাস। ১৪ ফেব্রুয়ারি সে কারনেই যেন চাপা পড়া ইতিহাস। কিন্তু আগামীদিনে যারা শিক্ষা ও গনতন্ত্রের জন্য লড়বে তারা তো ইতিহাস বিস্মৃত হতে পারে না। তাদের কাছে ১৪ ফেব্রুয়ারি যেন ছাই চাপা আগুনের মত, ভবিষ্যত আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিংগের মত। অতীত পিছন থেকে ঠেলে সামনে এগিয়ে নেয়। মধ্য ফেব্রুয়ারির স্মৃতিও তেমনি ভবিষ্যতের শক্তি হিসেবে প্রেরণা যোগাবে।
দ.ক.সিআর.২৫