➖
মারুফ কামাল খান
বাংলা নববর্ষ এলেই আমার কানে বাজতে থাকে যুগী হাড়ির টেনে টেনে উচ্চারণ করা সেই ঘোষণা। কালো মিশমিশে দোহারা গড়নের যুগী হাড়ির চেহারা ভুলে গেছি। কিন্তু পয়লা বোশেখ এলেই কানে বাজে তার আওয়াজ। আমি ফিরে যাই সেই স্মৃতিময় কৈশোরে।
যুগী হাড়ি ছিল আমাদের গাঁয়ের লোক। সাহা পাড়ার এককোণে খানিকটা অপাংক্তেয় ছিল তার ‘সাধ্যমতো ঘরবাড়ি।’ ছনের ছাওয়া, তল্লা বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরগুলো ছিল সুন্দর করে নিকানো। বাইরের ছোট্ট উঠানে থাকতো ঝিনুকের স্তপ। পাশেই ছিল মাটির উঁচু চুলা। সে চুলার গনগনে আগুনে ঝিনুক পুড়িয়ে চুন বানানো হতো। সে চুন রোজই আশপাশের হাটে নিয়ে গিয়ে বেচতো যুগী হাড়ি কলাপাতায় মুড়ে। সেটাই ছিল তাদের আসল পারিবারিক পেশা। আর হাটে হাটে বিভিন্ন ইস্যুতে ঢোল দেওয়া ছিল তার ‘সাইড ইনকাম।’
ঢোল দেওয়া মানে, ক্যানেস্তারা পিটিয়ে যুগী হাড়ি সকলের মনযোগ আকর্ষণ করে তার দরাজ কণ্ঠে টেনে টেনে ঘোষণা দিতো। বাংলা নববর্ষে আমাদের গাঁয়ের একপ্রান্তে মানাস নদীতীরে আমতলায় মেলা বসতো। কয়েকদিন ধরে সে মেলার প্রচার হতো। হাটে হাটে ঢোল দিয়ে যুগী হাড়ি সে মেলার প্রচার চালাতো। ওটাই ছিল আমতলার বৈশাখী মেলার অ্যাডভের্টাইজমেন্ট বা বিজ্ঞাপন।
যুগী হাড়ির মূল নাম ছিল যুগী। আর হাড়ি ছিল ওদের গোত্রীয় পদবি। বর্ণপ্রথায় বিভাজিত হিন্দু পাড়ায় সাহারা ছিল বৈশ্য আর হাড়িরা শূদ্র। সাহারা হাড়িদেরকে নমঃশূদ্র বলতো। দুই গোত্রের মধ্যে একধাপের ব্যবধান ছিল। কাজেই হিন্দুপাড়াতেও অপাংক্তেয় যুগীদের কিছুটা গুটিয়ে থাকতে হতো।
যুগী হাড়ির পরিবার ছিল তার স্ত্রী ও এক পুত্র, এক কন্যাকে নিয়ে। সবাই মিলে ঝিনুক কুড়াতো, চুন বানাতো। যুগী ও তার ছেলে বিভিন্ন লোকের ঝাড় থেকে কলাপাতা কেটে আনতো। আর হাটে গিয়ে পাতায় মুড়ে বিক্রি করতো চুন। ছেলের নাম সাধন আর মেয়ের নাম পূণ্যি ছিল – যদ্দুর মনে পড়ে। আমার দাদু পান খেতেন। তার চুন ফুরালে কখনো আমাকে পাঠাতেন যুগী হাড়ির বাড়ি থেকে চুন কিনে আনতে। আমি দু’-চার আনায় পিতলের চুনদানি ভরে কিনে আনতাম সাদা ধপধপে থকথকে চুন।
কী হলো সেই যুগী হাড়িদের? স্বাধীন বাংলাদেশ হলো। আমরা তখন বড় হয়ে গেছি। দাদাবাড়ির গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি ঢাকায়। যুগীদের খোঁজখবর আর রাখা হয়নি। শুনেছি একদিন কলেরায় সারারাত বমি করতে করতে ভোরে মরে যায় যুগী হাড়ি। সেটা ১৯৭৪ সাল, দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ। হয়তো তখন খুচরো পয়সায় চুন বিক্রির অর্থে সংসার চালানো দায় হয়েছিল যুগীর। ক্ষুধা মেটাতে কচুঘেঁচু এবং নানা অখাদ্য হয়তো খেতে হয়েছে তাদেরকেও। নিশ্চয়ই অপুষ্টির শিকার হয়েছিল তারা। এগুলো নিছকই কল্পনা। থাক, এ নিয়ে আর কল্পনা না করি। যুগী হাড়ির শবদেহ শ্মশানে পুড়িয়ে এসে কয়েকদিন বাড়িতেই ছিল তার পরিবার। মাঝে মাঝে তাদের ঘর থেকে ভেসে আসতো ক্ষীণকণ্ঠের করুণ বিলাপ ধ্বনি। তারপর একদিন সব স্তব্ধ হয়ে গেলো। এক ভোরে দেখা গেলো কেউ আর নেই যুগী হাড়িদের বাড়িতে। ওই পরিবারের সবাই উধাও হয়ে গিয়েছে। থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এসে বাড়ির দখল নিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, তার কাছে নাকি বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে যুগী হাড়ির বৌ তার বাপের বাড়ি চলে গেছে সন্তানদের নিয়ে।
সেই থেকেই আমাদের গাঁয়ে যুগী হাড়িদের ইতিবৃত্তের সমাপ্তি ঘটেছে। তবে বাংলা নববর্ষ এলেই আমার স্মৃতিতে বাজতে থাকে যুগী হাড়ির সেই কণ্ঠস্বর :
হবি হবি কী হবি?
আমতলা মেলা হবি।
আমতলার মেলার নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড় ও লাঠিখেলার কথা কখনো ভুলবো না এ জনমে।
ভুলবোনা মেলা ফেরত সেই বাঁশি, ভেঁপু, খেলনা টমটম গাড়ি ও ঢোলের মিলিত বিচিত্র আওয়াজ। মেলার কদমা, বাতাসা, ঝুরির স্বাদও কখনো ভোলা যাবেনা।
মেলা ছাড়া আর কী হতো আমাদের শৈশব-কৌশরের গ্রামীন নববর্ষে? হতো হালখাতার উৎসব। সব দোকান সাজতো নতুন সাজে। জ্বালানো ধুপের গন্ধে তৈরি হতো কেমন যেনো এক পবিত্রতার আবহ। সারা বছরের বকেয়া টাকা শোধ করতে আসতো বাঁধা খদ্দেররা। আমাদের পরিবারের বাকিতে জিনিস খরিদ না-করার রেওয়াজ ছিল পুরনো। তবু হালখাতা করতে দাদা কাউকে সঙ্গে দিয়ে আমাকে পাঠাতেন মাখন সাহার দোকানে। সেখানে পাঁচ টাকার নোট জমা দিলে খাতায় নাম উঠতো। অগ্রিম হিসেবে লিখে রাখা হতো পাঁচ টাকার অংক। মণ্ডামিঠাই দিয়ে আপ্যায়িত হয়ে ফিরে আসতাম তৃপ্ত রসনা ও হৃষ্ট চিত্তে। সেই সব নববর্ষ বাস্তবে না থাকলেও এখন স্মৃতিতে আছে অম্লান হয়ে।
শহরে ঘটা করে নববর্ষ উদযাপিত হয়। তবে সে উদযাপনকে আনুষ্ঠানিক মনে হলেও তাতে প্রাণের ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া কঠিন। অধুনালুপ্ত দৈনিক দেশ পত্রিকায় কাজ করেছি এক সময়ে। ওই পত্রিকার সংস্কৃতিমনা সাংবাদিকেরাই বাংলা নববর্ষে পান্তাভাত আর ইলিশভাজা খাওয়ার প্রচলন করেন। রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজনের ভেন্যুতে দৈনিক দেশ পত্রিকার উদ্যোগে পান্তা-ইলিশের স্টল খোলা হতো কয়েক বছর ধরে। দারুণ বিক্রি হতো। নাগরিক মধ্যবিত্ত হুমড়ি খেয়ে পড়তো সেই পান্তা-ইলিশের দোকানে। মিডিয়ার কল্যাণে সে বার্তা ছড়িয়ে যায় সবখানে। সেই থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অপরিহার্য রেওয়াজে পরিণত হয়েছে পান্তা-ইলিশ খাওয়া। এই রীতি প্রবর্তনের সঙ্গে চাকরিসূত্রে আমার নিজের কিঞ্চিৎ সংযোগ থাকলেও নববর্ষের পান্তা-ইলিশ আমার ততোটা আপন হয়ে ওঠেনি। আমার স্মৃতিতে কৈশোরের গ্রামীন নববর্ষের উদযাপন এখনো তরতাজা। হয়তো চিরকালই থাকবে। সেই আমতলার মেলা, যুগী হাড়ির ঢোল দেওয়া, নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড়, লাঠি খেলা, বাঁশির সুর, সেই বাতাসা, ঝুরি আর হালখাতার মিঠাইমণ্ডাই এখনো বাংলা নববর্ষে আমাকে স্মৃতিতাড়িত করে। কানে বাজতে থাকে ক্যানেস্তারার আওয়াজ আর যুগী হাড়ির ঘোষণা : হবি হবি কী হবি? আমতলা মেলা হবি।▪️
লেখক পরিচিতি : মারুফ কামাল খান : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
দ.ক.সিআর.২৫