➖
স্টাফ রিপোর্টার
মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম বৃহৎ শস্য ও মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত হাইল হাওর অস্তিত্ব সংকটে। প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় জীবিকা নির্বাহের গুরুত্বপূর্ণ এই জলাভূমিটি আজ দখল ও ধ্বংসের মুখে। সম্প্রতি শিল্পায়নের নামে কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তন করে হাইল হাওরের বিশাল এলাকা খনন করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হবিগঞ্জ এগ্রো লিমিটেড। স্থানীয় কৃষক, মৎস্যজীবী ও পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে কোম্পানিটি ১ হাজার একরেরও বেশি জমিতে শতাধিক এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কেটে ফিসারি নির্মাণ করছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদফতর ও কৃষি অফিসের অনুমোদন ছাড়াই, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে শুরু হয়েছে এই প্রকল্প। কৃষিজমি সংরক্ষণ আইন ২০২২-এর ৪ ধারায় কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তন দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও, তা মানা হয়নি। সরকারি খাস জমি, হাওরের বিল, গোপাট, ছড়া, খাল ও কৃষকের ব্যক্তিগত জমি জবরদখল করে চলছে এই কার্যক্রম। বাধা দিলে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১২ নম্বর গিয়াসনগর ও ১০ নম্বর নাজিরাবাদ ইউনিয়নে হবিগঞ্জ এগ্রো লিমিটেড হাওরের বিস্তীর্ণ জমিতে খনন কাজ চালাচ্ছে। কৃষক নেতা মো. খায়রুল ইসলাম জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, ফিসারি প্রকল্পের জন্য রাস্তা, ছড়া ও খালগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ফলে প্রায় ৩০-৪০ হাজার কৃষক ও খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামও উঠে এসেছে দখল ও অনিয়মে। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ আসনের সাতবারের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ভানুলাল হাইল হাওরের বহু সরকারি জমি দখল করে ব্যক্তিগত ফিসারি গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় দালালদের সহায়তায় কৃষকদের জমি জাল দলিল করে দখল করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
হাইল হাওর রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক আতাউর রহমান ও সদস্যসচিব কাজী এমদাদুর রহমান মঞ্জু অভিযোগ করে বলেন, এই পরিবেশ বিনাশী প্রকল্পের কারণে হাওরের দেশি মাছ, পাখি ও উদ্ভিদের প্রজননস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কৃষক, জেলে এবং গবাদি পশুর চারণভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে হুমকি ও মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাণ কোম্পানি প্রথমে কিছু জমি কিনলেও বাকি জমিগুলো সরকারি খাস ও কৃষকদের জমি জবরদখল করে নিয়েছে। কয়েকজন কৃষক দাবি করেন, তারা জমি বিক্রি না করলেও কোম্পানির পক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও দালালরা জাল দলিল তৈরি করে জমি দখল করেছেন।
জমির রকম পরিবর্তন করে প্রকল্প গ্রহণের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্থানীয়দের স্বাক্ষরসহ লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন কৃষক নেতা মোঃ খায়রুল ইসলাম। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, হাওর এলাকার ছোট ছোট গোপাট, ছড়া, খাল, নদী-নালা, গো-মহিষাদি চলাচলের রাস্তা ইত্যাদি বন্ধ ও নিশ্চিহ্ন করে বাউন্ডারী, অবৈধ সীমানা দিয়ে ব্যরিকেড করে হাওরের পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীর প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার সাধারণ কৃষকদের কৃষি কাজসহ গো-মহিষ চড়ানোতে বাঁধা প্রদান করে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে।
কৃষক নেতা খায়রুল ইসলাম বলেন, প্রাণ কোম্পানি বিভিন্ন ব্যক্তি থেকে অল্প পরিমাণ জায়গা ক্রয় করলেও প্রকল্পের অধীনস্থ করা দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি সরকারের খাস জমি এবং গরীব কৃষকদেও থেকে জোর করে অথবা জাল দলিলমূলে দখল করা হয়েছে। আমরা তথ্য প্রমাণসহ ডিসি অফিসে স্মারকলিপি দিয়েছি।
হাইল হাওর রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহবায়ক আতাউর রহমান ও সদস্যসচিব কাজী এমদাদুর রহমান মঞ্জু অভিযোগ করেন, হবিগঞ্জ এগ্রো লিমিটেড নামে প্রাণ আরএফএল কোম্পানি কর্তৃক হাওর পরিবেশ বিরোধী এ প্রকল্প জনসাধারণের ব্যাপক ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাওর থেকে বোরো ধান নিয়ে আসতে বাধা তৈরি করছে। প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বললেই কোম্পানির স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় কোম্পানীর ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্মকর্তারা গরীব কৃষকদের হুমকি দিচ্ছেন এবং ইতোমধ্যে মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে নানা ধরনের হয়রানি করছেন।
কাউয়াদিঘি হাওর রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক খছরু চৌধুরী বলেন, হাওর খনন করে ফিশারি করা সম্পূর্ণ বেআইনি জেনেও প্রাণ কোম্পানির হবিগঞ্জ এগ্রো কর্তৃপক্ষ শতাধিক এক্সেভেটর মেশিনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের স্টাইলে হাইল হাওর, কাওয়া দিঘিসহ হাওর বনাঞ্চল ধ্বংসের পায়তারার পরিকল্পনা করছেন। ফিসারি খননেন স্থানীয়রা বাধা দিলে উল্টা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। শিল্পায়নের নামে ফিসারি খনন প্রকল্প বন্ধ না হলে এবং এলাকাবাসির বিরুদ্ধে মামলা-হয়রানি বন্ধ না করলে আমরা রাজপথে আরও বড় পরিসরে আন্দোলন করবো।
পরিবেশবাদীরা হাইল হাওরের ঐতিহ্য রক্ষা এবং এই বেআইনি ফিসারি প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তারা সরকারের কাছে দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ এগ্রো লিমিটেডের ম্যানেজার শাহ আলমের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ ইসরাইল হোসেন বলেন, এ বিষয়ে স্মারকলিপি পেয়েছি। তদন্ত করে এ ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
দ.ক.সিআর.২৫