পার্বত্য তিন জেলার খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ও বান্দরবান বাংলাদেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ জুড়ে অবস্থিত। রাঙ্গামাটি জেলা দেশের বৃহত্তম জেলা হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং ভূমির অধিকার নিয়ে নানা ধরনের বিবাদ রয়েছে, যা বৈষম্যের শিকড়ে পৌঁছেছে।
সার্কেল চীফের ভূমিকা
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈষম্যের অন্যতম প্রধান উদাহরণ হচ্ছে ‘সার্কেল চীফ’ এর দ্বারা প্রদত্ত সার্টিফিকেট প্রাপ্তির প্রক্রিয়া। একজন ব্যক্তি যদি পার্বত্য জেলার যে কোনো অফিসে সদস্যপদ বা চাকরির আবেদন করতে চান, তাকে প্রথমে তার জাতিগত পরিচয় প্রমাণ করতে হবে। এটা নির্ধারণ করার জন্য তিন পার্বত্য জেলার সার্কেল চীফ কর্তৃক প্রদত্ত একটি বিশেষ সার্টিফিকেট প্রয়োজন। সার্কেল চীফ শুধু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই নিয়োগ করা হয়, ফলে বাঙালিরা এখানে সম্পূর্ণভাবে বাদ পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৪ নং ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি উপজাতীয় কি না এবং তিনি কোন উপজাতির সদস্য তা সার্কেল চীফ স্থির করবেন এবং সার্টিফিকেটের মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে হবে।” এই আইন আদিবাসীদের জন্য সুযোগ করে দিলেও বাঙালিদের জন্য এটি একটি বৈষম্য। একই ভাবে, কোনো ব্যক্তি অ-উপজাতীয় কিনা, সেটাও নির্ধারণ করতে হবে, কিন্তু এর জন্য সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দ্বারা প্রদত্ত সার্টিফিকেট লাগবে। ফলে সার্কেল চীফের অধিকার ও ক্ষমতা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
জেলা পরিষদে বৈষম্য
জেলা পরিষদের গঠন এবং এর কার্যক্রমেও বৈষম্য স্পষ্ট। জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী পরিষদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ৯ জন বাঙালি। তবে, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ৩৫ বছরের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত এই পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সদস্যদের মাধ্যমেই জেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা প্রাধান্য পাচ্ছেন।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা ১১ জন, যেখানে বাঙালি সদস্য মাত্র ৪ জন। একইভাবে, রাঙ্গামাটিতে ১০ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য এবং ৫ জন বাঙালি, আর বান্দরবানে ১১ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য এবং ৪ জন বাঙালি সদস্য রয়েছেন। এই সংখ্যাগুলোই দেখায়, কীভাবে জেলা পরিষদের উচ্চপদগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আধিপত্য রয়েছে, যা বাঙালিদের জন্য বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি করেছে।
চাকরি ও নিয়োগে বৈষম্য
জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রেও এই বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালে ৬৩ জন নার্সের মধ্যে ৫৩ জনই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আর বাঙালি মাত্র ১০ জন। এই ধরনের অনুপাত শুধুমাত্র একটি দৃষ্টান্ত নয়; অন্যান্য বিভাগেও একই চিত্র বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, সদর হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট এবং অন্যান্য বিভাগে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা বেশি, যেখানে বাঙালিদের সংখ্যা নগণ্য।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে বৈষম্য
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রেও এই বৈষম্য বিদ্যমান। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বোর্ড থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলায় শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য অধিকাংশ আসন বরাদ্দ করা হয়েছে, যেখানে বাঙালিদের জন্য বরাদ্দ অনেক কম। যেমন, খাগড়াছড়ি জেলার ৭৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কলেজ পর্যায়ে ৭১.৪% ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এবং ২৮.৬% বাঙালি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলাতেও অনুপাত প্রায় একই রকম। এতে বোঝা যায়, শিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রেও মেধার থেকে জাতিগত পরিচয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা বৈষম্যের আরেকটি উদাহরণ।
উন্নয়ন কাজেও বৈষম্য
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও বৈষম্য স্পষ্ট। ঠিকাদারি কাজ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, এবং অন্যান্য সরকারি প্রকল্পগুলোর বরাদ্দও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে বাঙালিদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হয় না। উদাহরণস্বরূপ, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, যা বাঙালি ব্যবসায়ীদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে।
সাংগঠনিক বৈষম্য
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্গানোগ্রামে ৭৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে বেশিরভাগ ক্লারিকাল (৩য় শ্রেণি) পদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে বাঙালিদের সংখ্যা নগণ্য। সাপোর্টিং স্টাফ (৪র্থ শ্রেণি) পদে বাঙালির সংখ্যা তুলনামূলক বেশি, তবে এটি কোনো সমতা বা সুযোগের প্রতিফলন নয়, বরং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত রেখে বাঙালিদের নিম্নপদে নিয়োগের একটি কৌশল।
উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অনুমোদিত অর্গানোগ্রামে ‘আইটি অফিসার’ নামে কোনো পদ নেই, কিন্তু একজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে এই পদে রয়েছেন। এটি পরিষ্কারভাবে দেখায়, কীভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, যেখানে বাঙালিদের জন্য সমান সুযোগ নেই।
সমাধানের পথ
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈষম্য দূর করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক পরিবর্তন। প্রথমত, পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া উচিত, যাতে সব জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা যায়। এছাড়াও, চাকরি ও শিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানো উচিত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বৈচিত্র্যময় অঞ্চল, যেখানে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের সহাবস্থান রয়েছে। এই অঞ্চলের উন্নয়ন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবার মধ্যে সমতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্য দূর করা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হতে পারে, যেখানে বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ উভয়েই সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।
লিখেছেন, তানজীব রহমান, খাগড়াছড়ি
দ.ক.২৪