➖
জাহেদ রহমান◾
আমরা জেনারেশন এক্সের মানুষ। আমাদের একটি বিশাল সুবিধা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছি। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা যেমন একটি জাতির মুক্তির সাক্ষী ছিলাম তেমনই আমরা এর বেড়ে ওঠার অংশ ছিলাম ও আছি এবং আমরা সফলভাবে এর পতনে অবদান রেখেছি। এটি এখন আমাদের দায়িত্ব যে আমরা জেনারেশন জিকে (জেন জি) দেশের পুনর্গঠনে সহায়তা করি।
আমি ঠিক তখনই শিশুকাল অতিক্রম করেছি যখন জাতি পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এক রাতে পূর্ব দিগন্ত আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছিল। সেই রাত, যা ঝিঁ ঝিঁ পোকার সুর ও মাঝে মাঝে রিকশার ঘন্টায় নিমগ্ন ছিল, সেটি মেশিনগানের ক্রমাগত শব্দে ভেঙে গেল। বড়রা ফিসফিস করে বলছিলেন রাজারবাগে বিশ্রামরত পুলিশ বাহিনীর ওপর দখলদার বাহিনীর এক ভয়াবহ আক্রমণের কথা। একজন শিশু হিসেবে আমি আকাশের রঙের পরিবর্তন, গুলির প্রবল ও লাগাতার শব্দে মুগ্ধ হয়েছিলাম, যদিও ভীত ছিলাম। দুই দিন পর আমরা হেঁটে ঢাকা ছেড়েছিলাম। গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা বড়দের জন্য বেদনাদায়ক, ভীতিকর ও বিপদসংকুল ছিল। আমি প্রায় পুরোটা সময় চাচা-মামাদের কাঁধে চড়ে পার করেছি। একজন শিশু হিসেবে আমি আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তবতা বা পাকিস্তানি বাহিনীর সারা দেশে চালানো নৃশংসতাগুলো বুঝতে পারিনি। উপরের আকাশে উড়ন্ত বিমানের নকল করা বা বন্দুকের মতো কিছু ধরে গুলি ছোড়ার অভিনয় করাটাই ছিল আমার শিশুসুলভ আচরণ।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে লাগল। একটি শিশুর নির্মল মন ক্ষুধা ও বঞ্চনার কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলো। সেটি ছিল ১৯৭৪; যা শিশুদের কচি মনে একটি অমোচনীয় ছাপ রেখে যায়। আমরা, প্রাক-কিশোর প্রজন্ম হিসেবে, ১৯৭২-১৯৭৭ সময়কালে সামাজিক অবিচার, বৈষম্য, ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। এর কিছু আমরা বুঝেছি, আর বাকিগুলো আমাদের বোধগম্যতার বাইরে ছিল। বাংলাদেশের অনেক তরুণ মন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিত্বে মোহাবিষ্ট ছিল। তবে সেই ঘটনাগুলো আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল, যা আমাদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় বিভক্ত করেছিল। প্রাক-কিশোরের উন্মাদনা আশির দশকে পৌঁছে যায়।
সেই সময় যখন আমাদের ভিতর গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্যতা ও দেশপ্রেমের ধারণাগুলো তৈরি হচ্ছিল, তখনই হাজির হলেন এক মাকড়সা, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি নিজেকে একজন কবি, প্রেমিক এবং স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তবুও মানুষ মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। তার নয় বছরের শাসন আমাদের আরও গভীরভাবে বিভক্ত করে; বিশুদ্ধ হৃদয়গুলি বামপন্থী, ডানপন্থী এবং মৌলবাদী মতাদর্শের ‘শরাবান তাহুরা’য় নিমজ্জিত হয়েছিল।
আমরা, জেনারেশন এক্স, খালেদা জিয়াকে সিংহাসনে আসীন করেছিলাম। তারপর আবার তাকে নামিয়ে শেখ হাসিনাকে সিংহাসনে বসিয়েছিলাম। এবং আবার খালেদা, আবার শেখ হাসিনা। ঠিক যেন মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা। আপনি যদি ডেমোগ্রাফিক প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করেন, তবে দেখতে পাবেন যে এই প্রজন্ম অর্থাৎ আমরা সর্বদা গত ৫০ বছরে চালকের আসনে ছিলাম; কিশোর, উদ্দীপ্ত যুবক এবং পরিপক্ক প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে। এই বয়স গোষ্ঠীগুলোকে পেশাগত ক্ষেত্রের সঙ্গে যদি সুপারইম্পোজ করা হয়, দেখা যাবে আশির দশক ও আশির দশকের শেষ দিকে আমরা বিভিন্ন স্তরের ছাত্র ছিলাম; মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক থেকে শেষ দিক পর্যন্ত আমরা কর্মক্ষেত্রের কার্যকর অংশ ছিলাম; হোক সেটা সরকারি, বেসরকারি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা, শিক্ষা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা সশস্ত্র বাহিনী। আমরা সাম্রাজ্যগুলো গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলাম। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে, আমরা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নিখাদ ব্যক্তি স্বার্থে সাম্রাজ্যগুলিকে লালন করেছি।
আমরা আমাদের রাজনৈতিক মালিকদের পুতুলে পরিণত হয়েছিলাম। যখন আমাদের প্রভুরা সিংহাসনের প্রতি আসক্ত ও আঠার মতো লেগে ছিলেন, আমরা সেই পরিস্থিতি থেকে সুবিধা নিয়েছিলাম। আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকার, বেসরকারি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা, শিক্ষা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সশস্ত্র বাহিনীতে মধ্যম স্তর এবং সিনিয়র স্তরের সমস্ত পদে পৌঁছেছিলাম। আমাদের প্রজন্ম কার্যত রাজনৈতিক প্রভুদের পক্ষে শাসন করেছে। আমরা, জেনারেশন এক্স, সকল প্রকার অসৎ কাজে লিপ্ত হয়েছি এবং অশ্লীল পরিমাণে সম্পদ অর্জন করেছি। আমরা পাপাচারে নিমজ্জিত হয়েছি।
বাংলাদেশের নাগরিকদের বিসর্জন দিয়ে আমাদের এই নরকযাত্রা আপাতদৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জহীন ও অপ্রতিহত ছিল। মানসিক, নৈতিক এবং শারীরিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে আমাদের উত্তরসূরি জেনারেশন জি (Gen Z)। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অত্যাচারী শাসকের পতন হয়। এটি আলোর পথে যাত্রা, নৈতিকতার এবং স্বাধীনতার পথে একটি আহবান।
আমাদেরকে, জেনারেশন এক্স, অবশ্যই এই নতুন শক্তি জেন জির সঙ্গে যোগ দিতে হবে এবং একসাথে আমাদের জাতি পুনর্গঠন করতে হবে। আমাদের এখন পাপমোচনের সময়।
কাহলিল জিবরানের “দি প্রফেট” এর কথা মনে পড়ে—
তোমরা তাদের ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তাদের চিন্তা নয়,
কারণ তাদের নিজস্ব চিন্তা রয়েছে।
তোমরা তাদের দেহকে আশ্রয় দিতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়,
কারণ তাদের আত্মা ভবিষ্যতের ঘরে বাস করে,
যেখানে তুমি যেতে পারবে না, এমনকি তোমার স্বপ্নেও নয়।
তুমি তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু তাদের তোমার মতো করতে চেয়ো না।
কারণ জীবন পিছনে চলে না এবং গতকালের সঙ্গে থাকে না।
তুমি সেই ধনুক, যেখান থেকে তোমার সন্তানরা জীবন্ত তীর হিসেবে ছুটে যায়।”
কালনেত্রের জন্য লিখেছেন: জাহেদ রহমান, সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
দ.ক.সিআর.২৪